প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
 
বাংলা সাহিত্য পড়লেই মনের ভিতরে উৎসুক হয় অন্ধকার যুগ, ওরফে  "বর্গি" লুঠপাট। সময়টা ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দ। ইতিহাস একটু লক্ষ্য করলে পাই, এই সময়টাতেই ইউরোপে  সাত বছর ব্যাপী যুদ্ধের প্রস্তুতিকাল।  তখন ইউরোপ জুড়ে গড়ে উঠেছে অস্থিরতা, আর বাংলা!  আলিবর্দি খান শাসিত বাংলা বিহার ও ওড়িশায় বর্গি আক্রমণে চরম বিপর্যয় । অত্যাচারের বেশ কিছু নথি ইউসুফ আলি খানে "তারিখ ই বাঙ্গালা ", কবি  ভারতচন্দ্র রায়ের " অন্নদামঙ্গলকাব্য ", গঙ্গারামের "মহারাষ্ট্রপুরাণ " কাব্যে পাওয়া যায়। এছাড়াও আরো অনেক প্রামাণ্য দলিল বর্তমান, যা  সাক্ষ্য রেখে যায় অবার্চীন আক্রমণের ফলিত ইতিহাস কান্না। 

আসুন দেখি ইতিহাস কি বলে! বাংলার রাজনৈতিক আকাশে তখন বুনো মেঘের আনা গোনা। ঠিক যেমনটা হেরে যাওয়া পটে ১৭৫৭ সাল ; বর্গি লুঠের দানা বাঁধা ইতিহাসে প্রলয়ের মহাকাল অভিশাপ। লুঠ মানেই ধর্ষণের হত্যা, হু হু শ্মশানের কান্নার জ্বালা জড়িয়ে বারাঙ্গনা আসর ;বাধ্য হয়েই পলায়ন কারী মনোভাবের ছায়াচিত্রে সেই সাহিত্যের চাপাকান্নার চিরাচরিতের আসর, 
"ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে। 
বুলবুলিতে ঘান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে।" 

কিন্তু শস্য শ্যামলা বাংলা এমন স্থান যেখানে মানুষ শিকড় গড়ে দেয় অযাচিতের হাত ধরেই। আর সে প্রমাণ ক্ষেত্রসমীক্ষায় উঠে আসে। যেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, এমন বর্গির লুঠের পরবর্তী অনেক মারাঠে সেনা নাকি মহারাষ্ট্রের মুখো হয়নি। আর এদের আবাসস্থলে  ইটাচুনা রাজবাড়ি গড়ে উঠেছিলো। এটা ভাবতে ভালো লাগে, লুঠ বা দ্বন্দ্ব শুধুই শেষ করে না, প্রতিষ্ঠাও করে। এমন করেই ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দ প্রতিষ্ঠিত হলো ইটাচুনা রাজবাড়ি,যা "বর্গি ডাঙ্গা" নামেও পরিচিত।  

তথ্যসূত্র বলে  রাজবাড়ির পূর্বপুরুষ মারাঠা বর্গির কুন্দন নাকি আর মহারাষ্ট্রে ফিরে যান নি। বর্গিরা মীর হাবিবকে হত্যার পর আক্রমণ বন্ধ করে দেয়।তবে তারা যখন উড়িষ্যার উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেন, সেই নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতেই   জীবনধারণের জন্য নিজস্ব  ব্যবসা শুরু করেন। তাঁরই বংশধর সাফল্যনারায়ণ কুন্ড। এদের সঙ্গে সম্পর্কিত কাটোয়ার কড়ুই গ্রামের কুন্ডর রাজবাড়ি। এই আক্রমণ নিয়েই গবেষণা অনেক তুঙ্গ।  উল্লেখ্য আচার্য যদুনাথ সরকারের " ফল অব দ্য মোগল এম্পায়ার "। 
উল্লেখ্য বইয়ের সাথে উপাদানের মেলবন্ধন যদি করতে চাই তবে দেখবো এই রাজবাড়ি, কিংবা বংশ পরম্পরার দ্বন্দের বাইরেও আছে লোকশ্রুতি, লোক ইতিহাস।  বাংলার বর্গিহানার করুণ পরিণতি হয়, কেতুগ্রামের বহুলাক্ষ্মী, নলহাটির নলাটেশ্বরী, বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা বাড়ি, কাটোয়ার ঝুপোকালী ইত্যাদি বহু দেব দেবীর নাম জড়িয়ে আছে৷ বহুলাক্ষ্মী, সতীপীঠের দেবীর ভৈরব " ভীরুক " বলে খ্যাত৷ কিন্তু, একতরফা বর্গিদের এই আক্রমণ জনসাধারণ মেনে নেয় নি। তারা তীব্র প্রতিবাদ করে৷ বর্গিরা সমষ্টির আক্রমণে ভয় পায় ও পালিয়ে যায়৷ হেতমপুরে বর্গি আক্রমণের শহিদ শেরিনা বিবির কথা লোকগাথায় বেশ বলিষ্ঠ ভাবে স্থান পেয়েছে৷ 

১৭০৭ সালে শেষ বিদায় নিলেন ঔরঙ্গজেব। তারপর মসনদে বসলেন মহম্মদ শা। বাদশাহের কন্যা শাহজাদী আমিনা, পিতার সেনাপতি ওসমানের প্রেমে পড়লেন। এদিকে পিতা ভাইপো হোসেন খানের সাথে আমিনার বিবাহ ঠিক করলেন। কিন্তু, একথা আমিনা মানতে নারাজ। তিনি সেনাপতি ওসমানের সাথে রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে গেলেন। ঘুরতে ঘুরতে তারা হেতমপুরে এসে পৌঁছালো। তখন বীরভূমের অধিপতি হাতেম খান। তাঁর কোনো সন্তান জীবিত  না থাকায়, পিতার স্নেহে তাদের আশ্রয় দিলেন। কিন্তু ততোদিনে আমিনা ও ওসমান নাম পরিবর্তন করে ফেলে, শেরিনা বিবি ও  হাফেজ খানে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য এই হাতেমের নাম অনুসারে "হেতমপুর" গ্রামের নাম হয়েছে৷ 

এরই মধ্যে ১৭৪২ সালে বাংলা বর্গি লুঠরাজের আক্রমণে অস্থির। মৃত্যুকালে সব সম্পত্তি শেরিনা বিবি ও হাফেজের নামে লিখে দেওয়ায়, তারাই কর্তৃত্ব করতে থাকে। এদিকে গোপনে আমিনা পিতার ভাইপো হোসেন খান সন্ন্যাসী ছদ্মবেশে আমিনা খোঁজ পেয়ে, বর্গিদের হাতে হাত মিলিয়ে হেতমপুর আক্রমণ করে৷ হাফেজ যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেয় এবং শেরিনা বীরাঙ্গনার মতো লড়াই শুরু করে। সামনে প্রণয়প্রার্থী হোসেনকে দেখে শিশুপুত্র সহ ছাদ থেকে দীধির জলে ঝাঁপ দেয় শেরিনা। মৃত্যুতে একটা অধ্যায় শেষ হয়। জনশ্রুতিতে আজও মানুষ বর্গিদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া বীরাঙ্গনার মৃত্যুতে সতী শেরিনার সমাধিকে ঈশ্বরের মতো শ্রদ্ধা করে। (ক্রমশঃ) 

#তথ্যঋণ  - 
১)"বঙ্গে বর্গিহাঙ্গামা "..  স্বপনকুমার ঠাকুর 
২) risingbengal.in..  ইন্টারনেট 
৩) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস 
৪) অন্নদামঙ্গলকাব্য
৫) আনন্দবাজার পত্রিকা 
৬) নিউজ বাংলা 
৭) প্রচলিত লোকগাথা

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours