প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, কলকাতা:

"বর্গি " কি শুধুই এক নাম!  হ্যাঁ, এক সেনাবাহিনীর নাম ; মারাঠি শব্দ " বার্গির " অপভ্রংশ;  মূলে আছে "বরচ" শব্দ,অর্থ " বল্লম নামক অস্ত্র "; অভিযানের সময় এদের গায়ে থাকতো সাত হাত লম্বা এক কম্বল ও হাতে একটি  বল্লম। এরা ছিলো মহারাষ্ট্রের ধনগর বা ধেনুগর বা  গোয়ালা জাতির শাখা। বলা হয় যে, শিবাজীর অধিকাংশ সেনাদল এই গোষ্ঠী থেকেই নেওয়া। তাই এদের ঘোড়া ও অস্ত্র নবাবকেই মেটাতে হতো। তথ্যসূত্র বলে, এরা হঠকর, যাধে ও খুটে এই তিনভাগে বিভক্ত ছিলো; হঠকর ধেনুগরেরা ছিলো যোদ্ধা জাতি ; যাধে ধেনুগরেদের কোনো তথ্য পাওয়া যায় না, আর খুটে ধেনুগরেরা ছিলো তাঁতি সম্প্রদায় ভুক্ত। এদের অনুচিত হঠকারী সিদ্ধান্তে নবাব পর্যন্ত নিরুপায় ছিলেন। এরা ছিলো রুক্ষমূর্তি,  কাম রসে অশ্লীলতার একনিষ্ট প্রতিনিধি৷ কিন্তু কোথাও এরা প্রভুভক্ত ও রাজপুত জনজাতির এক শাখা বলা যায়। 

আইন - ই - আকবরিতে এদের জেদ, হঠকারী ভাবনার সম্যক প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়৷ তথ্যসূত্র অনুসারে প্রাচীন ও মধ্যযুগে এরাই যোদ্ধা হিসাবে নিযুক্ত হতো৷ এমনই এক নাম দত্তবরটিয়া ; বসবাসের সূত্র ধরেই এদের পরিচিতি গ্রামের নাম অনুসারে বিধিবদ্ধ আছে। আসলে ইতিহাস তো এমন করেই রেখে যায় নাম। সম্পর্কের সূত্র ধরে চিনে নিতে হয়, পশ্চাতে থাকে নামকরণের প্রেক্ষাপট৷ এই বর্গিরা শিবের ভক্ত ছিলো। মুখে থাকতো " হর, হর " নাম। এদেরও কবর দেওয়াই রীতি ছিলো। পদ্মাসনে বসিয়ে মুখে সোনা দিয়ে, অনেকটা এখনকার মতো করেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হতো। কারণ বর্তমানেও কোনো মৃত মানুষের কাজে গীতার সাথে  পুরোহিতকে সোনা, রুপোর কুচি দেওয়াই, রীতি।

নিছক সত্য আলাপন করতে গেলে অষ্টাদশ শতকের বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের কথা উল্লেখ করতেই হয়। তিনি ছিলেন নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের  সভাপণ্ডিত। কিন্তু অকস্মাৎ  তিনি রাজা  কৃষ্ণচন্দ্রের বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন।সেইমূহুর্তে সুজাউদ্দিনের মতোই চিত্রসেন তাঁর জীবনে এক অন্য মাত্রা নিয়ে আসেন। তাঁরই আদেশে ১৭৪৪ সালে " চিত্রচম্পূ " লেখেন৷ এ যেন আলিবর্দির জীবনে পুনরাবৃত্তি চোখে পড়ে। মুর্শিদকুলির ক্রোধ সত্ত্বেও আলিবর্দি, শাসন নিজের হাতে সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহারে তুলে নিতে সক্ষম হন; আর এখানে বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার,  আবার কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে ফিরে গেলেও, পরে অবশ্য তিনি কলকাতার নবকৃষ্ণের কাছে আশ্রয় নেন৷

 ওয়ারেন হেস্টিংস যে ১১ জন পন্ডিতের সহায়তায় বিবাদার্ণবসেতু " নামে ধর্মশাস্ত্রসংগ্রহ রচনা, সেখানে 
বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের নাম উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে যান। তথ্যসূত্র বলে, এটাই নাকি তৎকালীনে সুপ্রিম কোর্টের একমাত্র আইনগ্রন্থ।  শূন্যপুরাণের ধর্মীয় তত্ত্বের আকর গ্রন্থ ও গদ্য পদ্য মিশ্রিত চম্পূ কাব্য। 
এখানে  মুসলমানদের জাজপুর প্রবেশ উল্লেখ আছে। গ্রন্থটি ২৫ টি অধ্যায় বিশিষ্ট।  এই সূত্রে বলতেই হয় যে,  শূন্যপুরাণে  বৌদ্ধদের শূন্যবাদ ও হিন্দু লৌকিক ধর্মের  মিশ্রণ চোখে পড়ার মতো। "চিত্রচম্পূ" তে কবির ভাষায় পাওয়া যায়,

" সংগ্রামে সমুপস্থিতে সুনিভৃতং দেশান্তরে সুদ্রুতং 
ধাবন্ত্যদ্ভুতবেগবাজিনিবিহো যেষাং প্রধানং বলম। " 

এছাড়াও শ্রদ্ধেয় সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইতিহাসাশ্রিত কবিতায় বর্গিদের সম্যক ছবি ফুটে ওঠে।
তথ্যসূত্রানুসারে, "মহারাষ্ট্রপুরাণে "  ভাস্কর পণ্ডিতের অধীনে ২৩ জন মারাঠা সেনাপতির নামের তালিকা আমরা পেয়ে থাকি। তাঁদের মধ্যে ধামধরমা, হিরামন কাসি, গঙ্গাজি আমোড়া, সিমন্ত যোশী, বালাজি, সেবাজি কোহড়া, শম্ভুজি, কেসজি আমোড়া, কেসরি সিংহ ও মোহন সিংহ  সম্পদ লুঠে নেতৃত্ব দিত। বালা রাও, শেস রাও, আরসিস পন্ডিত, সেমন্ত সেওড়া, হিরামন পণ্ডিত, মোহন রাত্র,পিত রাত্র, সিসো পন্ডিত, শিবাজি, সামাজি, ফেরঙ্গ রাত্র, সুনতান খাঁ,ভাস্কর পণ্ডিত ছিলেন যুদ্ধকর্মে ব্যস্ত। এছাড়া রণনিপুণ আলিভাই কারাওল এর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। এছাড়াও " বর্গি হাঙ্গামা " প্রবন্ধে ২০ জন বর্গি সর্দারের নামোল্লেখ বিদ্যমান৷ উল্লেখ্য যে ভাস্কর সহ সকল সেনাপতি আলিবর্দির হাতে নিহত হয়। 

এদের নৃশংহ আঘাত চোখে পড়ার মতো। তরোয়ালের আঘাতে অনেকেই নিহত হতো। মানুষের টাকা পয়সা, সম্পত্তি কেড়ে নিঃস্ব করতো এই বর্গিরা 
।এরা অঙ্গচ্ছেদ করতে সিদ্ধ হস্ত ছিলো। মানুষের নাক, কান, হাত, পা কেটে দিতো। প্রয়োজনে বুকের উপর চলতো তলোয়ারের আঘাত। এরা গ্রামের মানুষদের ভালো করে বেঁধে, জুতো সহকারে লাথি মারতো। এতেও যদি মানুষ তার সর্বস্ব না দিতো, তখন পুকুরের ডুবিয়ে ডুবিয়ে মারতো। তথ্যসূত্র বলে, রঘুজি ভোঁসলে যখন দুর্লভরামকে গ্রেফতার করে, তখন ২০০ জনকে বন্দি করে নাক, কান, কেটে দেওয়া হয়েছিলো। আসলে নবাব আলিবর্দির কাছ থেকে বালাজি রাও ২২ লাখ টাকা পেলেও রঘুজি রাও কিছুই দেন নি। শিশু, ব্রহ্মণ, গর্ভবতী নারীও  এদের হাত থেকে রক্ষা পায় নি। এরা গণধর্ষণ করতো। সুন্দরী মেয়েদের কেবল ধর্ষণ নয়, গলায় ফাঁস দিয়ে দুই হাত বেঁধে দিতো। আর তাতেই স্ত্রীরা ফাঁস আটকে মারা যেতো। 

১৬৮৩ সাল ছিলো ভয়াবহ৷ ১৬৮২ খ্রীঃ দ্বিতীয় বীর সংহের পর তাঁর পুত্র মল্লরাজ্যের সিংহসন আরোহন করেন।ঠিক এক বছর পর বর্গিরা গোয়া আক্রমণ করে।এদের উন্মাদগ্রস্থ যৌনসংগমের নেশায় নিজেদের স্থান ছেড়ে পালাতে থাকে। কোনো কোনো মহিলা ধর্ষণে বাধা দিলে তাদের স্তন তরোয়ালের আঘাতে কেটে নেওয়া হতো। ভারতচন্দ্রের " অন্নদামঙ্গল " কাব্যে এই ভয়াবহতার উল্লেখ পাওয়া যায়। 
" লুটি বাঙ্গালার লোকে করিল কাঙ্গাল।
গঙ্গার পার হইলো বান্ধি নৌকার জাঙ্গাল।। 
কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি। 
লুটিয়া লইলো ধন ঝিয়ড়ি বহুড়ী।। " এমন উল্লেখ পাওয়া যায় যে, বর্গির আক্রমণে কেতুগ্রামের উদ্ধারণপুরে এক পুরো পরিবার ভুল সংকেতবহ করে নিজের ভৃত্যকে হারায় ও নিজেরা 

পাতালঘরেই মারা যান। অনেকেই এদের অত্যাচার ও ভয়াবহতার সাথে মগ ফিরিঙ্গিদের তুলনা করে৷ তবে মগেরা ছিলো জলদস্যু। এরা দাস করে হাটে বিক্রি করতো, অর্থাৎ মানুষ ছিলো এদের কাছে পশরা স্বরূপ৷ সাহিত্য ও ইতিহাসের খাতায় ভয়বহতা বলতে এই  বর্গি আক্রমণ এক এবং অদ্বিতীয় বর্বরোচিত হিসাবেই চিহ্নিত। 

ঋণস্বীকার..... 
১) বঙ্গে বর্গিহাঙ্গামা ইতিহাস ও কিংবদন্তি.. 
 স্বপনকুমার ঠাকুর 
২) "গিরিয়ার প্রথমযুদ্ধের গ্রাম্যকবিতা " মুর্শিদাবাদ কাহিনি, নিখিলনাথ রায়
৩) ইন্টারনেট  উইকিপিডিয়া 
৪) বর্ধমান সহায়িকা 
৫) অন্নদামঙ্গল কাব্য 
৬) প্রচলিত লোকগাথা 
৭) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস 
৮) "মহারাষ্ট্র পুরাণ" 
৯) "বণিক বার্তা " ( ইন্টারনেট)  
১০) "বঙ্গদর্শন " ( ইন্টারনেট)  
১১) ইতিহাস অভিধান 
১২) পলাশির অজানা কাহিনি,  সুশীল চৌধুরি
১৩) " বঙ্গদর্শন ইতিবাচক বাংলা " 
১৪) bengali.koulal.com
১৫) "বঙ্গে মগ ফিরিঙ্গি ও বর্গির অত্যাচার " 
১৬) "বাঙ্গালায় বর্গীর হাঙ্গামার প্রাচীনতম বিবরণ ", চিত্তহরণ চক্রবর্তী
১৭) "আইন ই আকবরী...", আবুল ফজল 
১৮) বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার - হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
১৯) "চিত্রচম্পূ "... 
২০) বাঙ্গলার ইতিহাস নবাবী আমল

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours

  1. এ লেখার প্রায় প্রতিটি বাক্যই কোন না কোন লেখা থেকে তুলে বসানো - বলা যেতে পারে একটা টুকলির সঙ্কলন। যেহেতু লেখাটির থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায় তাই সে দোষকে অগ্রাহ্য করা যেত যদি না ঋণ স্বীকারের নামে একটা লম্বা তালিকা ধরিয়ে কোন বাক্যটা কোন লেখার থেকে নেওয়া জায়গা মত যথাযথভাবে তার reference দেওয়া থাকত। আশা করি ভবিষ্যতে লেখিকা এই অনুরোধটি রক্ষা করে পাঠক, বিশেষত গবেষকদের,অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়িয়ে নেবেন।

    ReplyDelete