সেমন্তী মুখোপাধ্যায়, লেখিকা, কলকাতা:

রচনা লিখতে বসিনি। চা পান করতে করতে সখেদে দুটো মনের কথা বলব। তাই শিরোনাম দেখে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। একাল আর সেকাল নিয়ে আলোচনা করতে বসলেই পাল্লা ভারি হয় সেকালের। সেকালের সব ভালো, একালের সব খারাপ!
পথের পাঁচালী বইটা একালে পড়ে শুধু সেকালের লোকরাই, যারা নাকি ছোট থেকে পথের পাঁচালী মেখে-খেয়ে বড়ো হয়েছেন! একালের ইংলিশ মিডিয়ামের ট্যাঁশ ছেলেমেয়েগুলি, যারা কিনা বিজাতীয় উচ্চারণে বাংলা উচ্চারণ করে আর ফেলুদার ইংরেজি অনুবাদের পড়ে, ওরা পড়বে 'পথের পাঁচালী'? ছোঃ! 
হে জ্ঞানবৃদ্ধ ব্যক্তিসকল, আপনারা ঐ সকল ট্যাঁশদের মূর্খ ভাবেন এবং মনে করেন বাংলা সাহিত্যকে ওরা ছুঁলেই তা অপবিত্র হয়ে যাবে! তাই রে-রে করে তেড়ে আসেন।

এইবার ঝাঁপি খুলি। বহুবছর সি.বি.এস.ই. বোর্ডের ছেলেপুলে পড়াই। ক্লাস নাইনে ওদের আগে "আম আঁটির ভেঁপু" পুরো বইটা পড়তে হত দ্রুতপঠনে, এখন শেষের তিনটি বাদ দিয়ে পুরো ষোলোটি পরিচ্ছেদ। একবার নাইনের একটা গ্রুপ কাঁচা আম জারিয়ে খেয়েছিল নিজেরা ব্যবস্থা করে। 
একটি ছেলের কথা খুব মনে পড়ে। তার মা-বাবা দুজনেই ডাক্তার। ছেলেটি ব্যাচে পড়তে এসে এককোণায় চুপচাপ বসে থাকত, বিশেষ কথা বলত না। ভ্যাকেশনে মা-বাপের সঙ্গে পচা ইন্ডিয়ার বাইরে বেরিয়ে যেত। ব্র্যান্ডেড জামাকাপড় বোঝাই যেত দেখে। ক্লাস শেষ করে সে তার বাবার পাঠিয়ে দেওয়া অডি গাড়িতে চড়ে চলে যেত। মাসের পয়লা তারিখে সুদৃশ্য খাম সে আমাকে জমা করত। একদিন ক্লাস শেষ করে একটু রেস্ট নিচ্ছি। ছেলে-মেয়েরা বেরিয়ে গেছে। হঠাৎ দেখি সে তার মাকে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। তার মা এসে একটু অপ্রস্তুত হাসি দিলেন, "ম্যাডাম, ছেলের জন্য আসতেই হল।" আমি দ্রুত মনে করার চেষ্টা করলাম, সম্প্রতি ছেলে ক্লাসটেস্টে কেমন নম্বর পেয়েছে! ছেলের মা আরেকটু ভুবনভোলানো হাসি দিলেন। দেখতে চোখা, ঠোঁটে আছে-আছে অথচ নেই-গোছের স্মার্ট লিপস্টিক। লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, "এবার পুজোয় স্পেনে যাব, ঠিক ছিল। অথচ দেখুন এই ছেলেটা বায়না ধরল...(ছেলের দিকে ফিরে)... বল্ না, নিশ্চিন্তপুর না কি বললি!" ছেলে দৃঢ় উচ্চারণে জানাল,"নিশ্চিন্দিপুর"। ভদ্রমহিলা আবার বললেন, "হ্যাঁ, ওখানে যাবে বলে ধরে বসে আছে। কিভাবে যাব বলুন তো? আমরা তো বাই কার যাব। ভালো রিসর্ট আছে?"
সেদিন ভদ্রমহিলাকে বুঝিয়ে বলতে পারছিলাম না। ছেলেটি আশাভঙ্গের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে বীরভূম ঘুরে আসতে বলেছিলাম। তারপরেও আপনারা একাল আর সেকাল নিয়ে তর্ক করেন?

আরও পিছিয়ে যাই। তখন ক্লাস ফাইভ। প্রথমবার টিভিতে "পথের পাঁচালী" সিনেমা দেখব। আনন্দের চোটে পাড়ার এক খেলার সাথীকে বলে ফেললাম টিভিতে রবিবার "পথের পাঁচালী" দেখব। প্রথমবার দেখে আমি তো উদ্বেলিত। দুদিন পর বাজারের পথে তার মা আমার মাকে বললেন,"কী একটা সিনেমা দেখতে বলেছিল আপনার মেয়ে! আমার মেয়ে ঐসব সাদাকালো সিনেমা কি আর দেখে!" খেলার সাথীটি বাংলা মিডিয়ামেই পড়ত!

পরের রবিবার সেই খেলার সাথী মেয়েটি খুবই তিতিবিরক্ত হয়ে আমাকে বলল, "সবসময় এতো বড়োদের সিনেমা কেন দেখিস রে!" অপু-দুর্গাকে চেনে না! সেই রাগে আড়ি করে দিলাম! 
আরও অনেকদিন পর স্কুলে ক্লাস সিক্সে "আম আঁটির ভেঁপু" দ্রুতপঠনে রাখলাম। আবার নাইনে উঠে পড়বে, একটু পরিচিতি হোক। ইংরেজিতে দ্রুতপঠনে ছিল চার্লস ডিকেন্সের "ডেভিড কপারফিল্ড"।
কয়েকদিন পর ক্লাসে গিয়েছি। "নেবুর পাতায় করমচা" পড়াচ্ছিলাম। পড়ানো শেষ হবার পর একটি মেয়ে বলল, "ডেভিডের থেকে অপু অনেক ভালো।" খুব ইন্টারেস্টিং বিষয়। খুব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "কেন?" মেয়েটি সরল চোখে বলল, "অপুর মতো আম কুড়োতে যেতে ভালো লাগে, কাঁচা আম আমিও চুরি করে মেখে খাই। ডেভিডের জীবনটা যেন কেমন! ডেভিডের মায়ের মতো কেউ কি ওরকম ব্যবহার করে ছেলের সঙ্গে?" আমি উত্তরোত্তর অবাক হচ্ছিলাম। এরাও এতো গুছিয়ে ভাবে! বললাম, "না, ডেভিডের মা তো কিছু করেনি। ডেভিডের স্টেপফাদার ওরকম করত!" এই কথার উত্তরে আরেকটি মেয়ে বলল, "ডেভিডের মা ওরকম লোককে বিয়ে করল কেন? আমাদের মা হলে কি করত?"

চুপ করে ভাবছি কি বলি! এমন সময় প্রথম মেয়েটি বলল, "আম আঁটি ভেঁপুতে সবাই সবাইকে কতো ভালোবাসে, দুঃখ দেয় না। দুর্গাকে ওর মা মারলেও অপু দিদির জন্য দুঃখ পায়।" একটি ছেলে জানাল, সে-ও মহাভারতের যুদ্ধবিস্তার কল্পনা করত!

ওরা ক্লাস সেভেনে "রাজকাহিনী" পড়তে শুরু করার পর আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "ক্ষীরের পুতুল", ""পাগলা দাশু", "ভোম্বল সর্দার", "আম আঁটির ভেঁপু" আর "রাজকাহিনী"- এর মধ্যে কোনটা সবথেকে ভালো? সবাই জানিয়েছিল "আম আঁটির ভেঁপু"।

শাশ্বত সাহিত্যের একাল সেকাল নেই। এই সাহিত্যকে চিনতে গেলে আঁতেল হওয়ার প্রয়োজন নেই। ভোঁতা মন কখনোই সাহিত্যের রস আত্মস্থ করতে পারেনি। সেটা সেকালেই হোক, আর একালেই। 

শাশ্বত সাহিত্যের রসাস্বাদনের উপায় গিয়েছে বন্ধ হয়ে। সেটাও মস্ত বড়ো সমস্যা। সেখানেও একটা ছোট্ট অভিজ্ঞতা বলি। বাড়িতে ব্যাচ পড়াচ্ছি। পড়া-শেষে এক মা তার মেয়েকে নিতে এসে বললেন, "এরকম একটা টেক্সট সিলেবাসে রাখা কি ঠিক?" হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে তিনি অনুকম্পার দৃষ্টি দিয়ে আমাকে বোঝালেন, "সর্বজয়া কিরকম একপেশে মা নয়? অপুকে পাঠশালায় পাঠাল, দুর্গাকে বাড়ি বসিয়ে রাখল?" নারীবাদী ভাবনা বটে! কিন্তু আমার ছাত্রীটি ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। সে হাত-পা নেড়ে সোৎসাহে তৎকালীন পটভূমি ব্যাখ্যা করে মায়ের যুক্তি নস্যাৎ করল। 

তাই তো বলি! একাল মানেই হাল্কা চাল নয়, শুধু ইংরেজি অ্যাকশন থ্রিলার, হ্যারি পটার নয়। আপনি কি তাদের ঠাকুরমার ঝুলি কিনে দিয়েছেন? পড়তে শিখিয়েছেন? তাও তারা "পথের পাঁচালী" পড়ে নিশ্চিন্দিপুর খুঁজতে যায়। তাদের জীবনে রূপকথার আকাল। তাই তারা রূপকথা খুঁজে পায় "পথের পাঁচালী"-তে। একাল আর সেকাল নিয়ে এই রূপকথার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

2 comments so far,Add yours

  1. একটা স্বল্প আলোচিত দিগন্ত উন্মোচিত হল। আমরা অনেকসময় একপেশে ভাবনার আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে চোখ মেলে তাকিয়ে চারপাশে দেখার ফুরসত পাই না। সেটা আবার বোঝা গেল।

    ReplyDelete