প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
 
আলিবর্দি খাঁ - এর প্রকৃত নাম মির্জা মুহম্মদ আলি। মুঘল দরবার তাঁকে "খান " উপাধি দেয়। বংশ পরিচয় বলে, আলিবর্দি খাঁ এর মা ইরানের খোরাসানের এক তুর্কি উপজাতি  থেকে এসেছিলেন ; তাঁর পিতামহ ছিলেন ঔরঙ্গজেবের সৎ ভাই। ঔরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র আজম শাহে তাঁকে পূর্ণবয়স্ক হবার সাথে সাথেই পিলখানার পরিচালক হিসাবে নিয়োগ করেন৷ ১৭০৭ ইতিহাসের এক ইন্দ্রপতন, সাথে পরিবারগত বিবাদের পুনরাবৃত্তি বলা  যেতে পারে। কিন্তু বিবাদের যে ফলশ্রুতি তা নঞর্থক।  আজম শাহের মৃত্যুর পর একপ্রকার ফাঁকা হাতেই আলিবর্দি ভাগ্যান্বেষনে বেরিয়ে পড়েন। ১৭২০ সালে তিনি সপরিবারে বাংলায় চলে আসেন। কিন্তু প্রাথমিকে নবাব মুর্শিদকুলি  খাঁ তাঁকে পাত্তা দেন নি। অধিক চেষ্টা সত্ত্বেও আলিবর্দি একপ্রকার নিরাশ হয়েই ফিরে আসেন৷ কিন্তু এক দরজা বন্ধ হলে আরো এক দরজা খুলে যায়। মির্জা মুহম্মদ আলী, মুর্শিদ কুলি খাঁর জামাতা সুজাউদ্দিনের আত্মীয় থাকায়, তাঁকে সম্মান সঙ্গে গ্রহণ করেন।আলিবর্দি খাঁ কে তিনি রাজস্ব বিভাগে ১০০ টাকার বেতনে  কাজ দেন৷  এতে মুর্শিদকুলি খাঁ চরম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, কিন্তু ধীরে ধীরে সুজাউদ্দিনের বিশ্বাসের আকর হয়ে ওঠেন। সুজাউদ্দিন, তাঁকে উড়িষ্যার কিছু জমিদারি তদারকি করতে দেন।  এককথায় তৎকালীন সময়ে উড়িষ্যায় শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপন করতে আলিবর্দি ভূমিকা অপরিসীম। 

মুর্শিদকুলি খাঁ, একপ্রকার ভালোবাসা বশত সরফরাজকে সিংহাসন দেবার প্রতিশ্রুতি দেন৷ কিন্তু সুজাউদ্দিন জানতেন যে সরফরাজ অকর্ম ন্য। তাই তাঁকে সিংহাসনে বসিয়ে  সে ভুল করতে তিনি নারাজ। আলিবর্দি খুব নাটকীয় ভাবেই এই কাজে সরফরাজ কে ঘনিষ্ঠ আমলা দিয়ে বুঝিয়ে সুজাউদ্দিনকেই নবাবী পদ দিলেন। কিন্তু এখানে আলিবর্দি জানতেন, যে, তিনি সরফরাজকে আজ সরিয়ে দিলে , তিনি নিজেই সুজাউদ্দিনের প্রিয়তম হয়ে উঠবেন৷ ততদিনে মাটি শক্ত হলে সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর অকর্মন্য সরফরাজকে সরাতে তাঁর বেশী দিন লাগবে না। আর এই সুযোগে তিনি বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত হলেন৷ ইতিহাস তাঁর এই আশায় জল ঢালে নি; কারণ সত্যিই সুজাউদ্দিনের পর তিনিই ১৭৪০ খ্রীস্টাব্দে বাংলার নবাব হলেন।শ্রদ্ধেয় স্বপন কুমার ঠাকুর তাঁর  তথ্যসূত্রে  উল্লেখ্য করেছেন,   "গিরিয়ার প্রথমযুদ্ধের গ্রাম্যকবিতা " মুর্শিদাবাদ কাহিনি, নিখিলনাথ রায়, 

"মারামারি লেগে গেল গিরিয়ার ময়দানে। 
কান্দে বাঙলার সুবাদার হাপুস নয়নে।।" (পৃ ৬১৯)
 বাংলার বুকে যে অসন্তোষের তুষ জ্বলে ওঠে, তা ক্রমান্বয়ে আলিবর্দির সময় তুঙ্গ হয়ে ওঠে৷ এ এক নিরবচ্ছিন্ন অরাজকতা তখন; তদানীন্তন কালে বঙ্গে নতুন উৎপাত হলো, মহারাষ্ট্রীয়দের বাংলায় আসার সঙ্গে সঙ্গে ভোঁসলা রাজার দেওয়ান ভাস্কর রাওয়ের নেতৃত্বে চল্লিশ হাজার আশ্বারোহী সৈন্য মেদিনীপুর, বর্ধমান, বাঁকুড়া বিবিধ স্থানে এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু আলিবর্দি এসেই কি করলেন!  স্বজনপোষণ!  নাকি বিস্তার!  ভগ্নিপতি মীরজাফরকে দিলেন মিরবক্সে পদ, তিন কন্যার বিবাহ ও জামাতা নোয়াজেস পেলেন  ঢাকার শাসনকর্তার পদ  আর যে উড়িষ্যায় নিজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সুজাউদ্দিনের সাহায্যে, আজ সেই উড়িষ্যাকে দিলেন সৌলদজঙ্গকে। কিন্তু সুজাউদ্দিনের জামাই রুস্তম জঙ উড়িষ্যাকে ছাড়তে রাজী হলেও, বেগম দুর্দানা ও জামাতা বাকর আলির চাপে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। সময়টা ১৭৪১ খ্রীস্টাব্দ, কটকের ফুলবাড়ি যুদ্ধে আলিবর্দি জিতে গেলেন৷ তারপর কয়েক মাসের মধ্যেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেলো এবং তিনি এই বাংলায় ফিরে এলেন। "অন্নদামঙ্গল " কাব্যে এ কথা স্পষ্ট ভাবে স্থান, কাল ধরে লেখা আছে। কিন্তু,  কবি ভারতচন্দ্র বিধর্মীদের যথেচ্ছাচারকেই বর্গিহাঙ্গামার মূল কারণ দেখিয়েছেন৷ "মহারাষ্ট্র পুরাণ " নামে কাব্যে কবি গঙ্গারাম লেখেন,
"মঠ ঘেরিয়া বরগী দেয় তবে সাড়া। 
সোনা রূপা লুটে নে এ আর সব ছাড়া।।" 

তখন মুর্শিদাবাদ অরক্ষিত।  সাধরণ মানুষ কেবল নয়, জগৎ শেঠের মতো ব্যক্তি ধনরত্ন নিয়ে ঢাকায় চলে যেতে বাধ্য হন। সাময়িকে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগর ত্যাগ করে ইছামতীর তীরে বসতি গড়েন।শ্রদ্ধেয়  যদুনাথ সরকার এই মারাঠা আক্রমণকে "passing blost " বলেছেন। মুর্শিদাবাদে যখন আলিবর্দি পৌঁছান, তখন বর্গিরা বীরভূম জেলাকে রেখে বর্ধমানের দিকে অগ্রসর হয়। সাথে সাথে আলিবর্দিও বর্ধমানের রাণিসায়রের পাড়ে এসে তাঁবু খাটালেন। এই দিঘি ১৭০৯ সালে রাজা কীর্তিচন্দ্র রায়ের মাতা ব্রজকিশোরীদেবী খনন করেছিলেন৷ তাঁর স্বামীও স্নান করতে করতে এই জলেই আততায়ীর হাতে হত্যা হন৷ তারপর নিষিদ্ধের বেড়া ডিঙিয়ে ছয় বছর পর এই দিঘি কাটানো হয়৷ ১৭৪২সালে ১৬ ই এপ্রিল মারাঠা বর্গিরা এই রানিসায়রকে ঘিরে ফেলে। আতঙ্কগ্রস্থ বাসীন্দাররা তখন বর্ধমান ছাড়ে। নবাবি সৈনদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে উঠেছিল।  চরম খাদ্যাভাব এমন অবস্থায় পৌঁছেছিলো যে, শুধুমাত্র কলার এঁটে সেদ্ধ খেয়ে খেয়ে তাঁরা বেঁচে ছিলো। নবাব আলিবর্দি তখন বাধ্য হয়ে ভাস্কর পণ্ডিতের মত নেন। একপ্রকার অর্থের রাজনীতিতে কূটকৌশল নিয়েই দুর্ভেদ্য জাল ভেদ করেন কাটোয়ার পথে যাত্রা করেন। (ক্রমশঃ) 

@তথ্যসূত্র - 
১) বঙ্গে বর্গিহাঙ্গামা ইতিহাস ও কিংবদন্তি.. 
 স্বপনকুমার ঠাকুর 
২) "গিরিয়ার প্রথমযুদ্ধের গ্রাম্যকবিতা " মুর্শিদাবাদ কাহিনি, নিখিলনাথ রায়
৩) ইন্টারনেট  উইকিপিডিয়া 
৪) বর্ধমান সহায়িকা 
৫) অন্নদামঙ্গল কাব্য 
৬) প্রচলিত লোকগাথা 
৭) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস 
৮) "মহারাষ্ট্র পুরাণ" 
৯) "বণিক বার্তা " ( ইন্টারনেট)  
১০) "বঙ্গদর্শন " ( ইন্টারনেট)  
১১) ইতিহাস অভিধান 
১২) পলাশির অজানা কাহিনি,  সুশীল চৌধুরি

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours