চৈতালী সেনগুপ্ত, লেখিকা, কলকাতা:

    সব সময় চাইলেই লেখা যায় না। এই যে এত দুর্যোগ, মানুষের অসহায়তা, ভোগান্তি, পৃথিবীর রোষ, প্রকৃতির তান্ডব, ফেসবুকের লেখার ছড়াছড়ি, আমি পড়ি... কষ্ট ও পাই, কিন্তু এক কলম ও লিখতে পারিনা। সবাই টিভি দেখে, খবরের কাগজ পড়ে সবটা জানতে পারে। তবে আরও একটু লিখে মানুষের ভয়কে আরো একটু বাড়িয়ে দিতে মন চায় না।
      ঝড় দেখেছি এর আগেও অনেকবার। ২০০৯ সালে আয়লা দেখেছিলাম, এবার আমফান। ১৩৩ কিলোমিটার বেগে সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ, কলকাতা, আর বাংলার  বুকের উপর দিয়ে ধংস করতে করতে বয়ে গেল। সেদিন সেই কোন সকাল থেকে ডেকে ডেকে উড়ে যাচ্ছিলো পাখিটা এদিক থেকে ওদিক। ছুটে বেড়াচ্ছিল বোধহয় একটা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। আমাদের বাড়ির পাশের বাগানের কোন গাছে বোধহয় আছে ওর ছোট্ট বাসাটা। কোরোনার আতিমারীতে সব মানুষ যখন গৃহবন্দী, সেই সময় হঠাৎ পাখিদের আনাগোনা আর ডাকাডাকি বেশ মনোরম করে তুলেছিল নিস্তব্ধ পরিবেশটাকে।এক অখন্ড অবসরে যখন চতুর্দিকের ঘরবন্দী মানুষগুলো তাদের আগত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন ওদের কিচিরমিচিরে খানিক হলেও ভুলে যেতাম সব। কাল অবধি যে ডাক খুব সুরেলা লাগতো, আজ যেন হঠাৎ সেই একই ডাক শুনে ওদের আর্তনাদ মনে হচ্ছে। হয়তো বুঝতে পেরেছে ওদের সুখের বাসাটি কাল ভেঙে ছিঁড়ে মাটিতে আর কাদায় লুটিয়ে যাবে। কিভাবে রক্ষা করবে নিজেকে আর ওদের পরিবারকে কে জানে! আমার চোখে এই পাখির ডাকই ছিল 'ঝড়ের পূর্বাভাস'। বেলা বাড়লো, হাল্কা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশের কোনায় একটু একটু করে জমাট বাঁধছে ঘন কালো মেঘেরা। একজন সবজি বিক্রেতা তার ঠেলা গাড়িতে করে বাড়ি বাড়ি সবজি ফেরি করতে হাঁকছে....."সবজি নেবেএএন সবজিইইইই".....কেউ নিচ্ছে কেউ নিচ্ছে না। আপাদমস্তক ভেজা একটা মানুষ গলা চিড়ে ঠেকে চলেছে। ঝড় এর আগেও দেখেছি কিন্তু এমন দুর্যোগ মাথায় করে এভাবে কাউকে বেরোতে দেখিনি আমি। প্রকৃতির নিষ্ঠুর আচরন আজ কতোটা নিঃস্ব করেছে মানুষকে  ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়। ওই মানুষটি কতোটা দুশ্চিন্তা নিয়ে ঝড় বাদল উপেক্ষা করে সবজি বিক্রি করতে বের হয় ভেবেছেন? বেলা যত গড়ালো, বাড়লো আরও খানিক শীতল ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির প্রকোপ। বিকেল চারটে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ।  ঘড়িতে সময় সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা অথবা ছয়টা। এতোক্ষণে ঝড় নিরীহদের প্রতি তার বিক্রম ফলাতে শুরু করেছে। ঝড় আমরা কি বুঝি? আমাদের কংক্রিটের তৈরি দেওয়াল, পাকা ছাদ, এক চিলতে বারান্দা আর আশেপাশের বাড়ির বাগানে, টবে আর বহু দূরে গুটিকয় গাছপালা।তাও সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে  কাছের আর দূরের  গাছগুলোর, বহু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল সুপারি গাছের উপর ঝড়ের আষ্ফালনের জেরে অসহায় আর করুণ পরিণতি দেখলাম। এক এক সময় ভয়ে আঁতকে উঠলাম।কোথা থেকে এক প্রকান্ড টিনের চাল উড়ে এসে পড়লো সামনের বাড়ির ছাদে। পাশের বাগানে একে একে তিনটে আমগাছ আছড়ে পড়ল মাটিতে। চতুর্দিকে মেঘের গর্জন, কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ, টিন ওড়ার শব্দ, গাছের ডাল ভাঙার শব্দ আর বাতাসের গোঙানি। ঝড় তখন বীর বিক্রমে ক্ষত-বিক্ষত করে চলেছে চারপাশ। রাত সাড়ে নয়টা দশটা নাগাদ ঝড়ের তান্ডব চলার পর একটু শান্ত হল পরিবেশটা।
         সারা রাত একটানা বৃষ্টি চলার পর সে এক অন্য সকাল। চারিদিক থেকে খবর আসতে থাকে, ভেঙে পড়েছে শয়ে শয়ে গাছ, ল্যাম্পপোস্ট।  বিদ্যুৎ সরবরাহ, ইন্টারনেট পরিষেবা, খাবার আর ব্যাবহারের জল, কেবল্ সব কিছুর অচলাবস্থা, প্রবল অসুবিধা। ভাবলাম.…...ওও এই ছিল তবে ঝড়। মানুষ দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ আর জলের অভাবে অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে। আর ওদিকে, দিনে খাওয়া নেই, রাতে ঘুম নেই.... কত মজুর কাজ করে চলল কলকাতাকে সচল করতে। চোখের সামনে দেখলাম রাত বারোটায় একদল মানুষ গাছ কাটছে,  আর একদল দাঁড়িয়ে আছে গাছ কাটার পর বিদ্যুতের লাইন সারাতে  হবে। সেখানে আরও একটা বিরাট দল ও আছে, যারা পাহাড়া দিচ্ছে এদিকের কাজ শেষ হলে অন্য দিকটা সারানোর জন্য ওদের নিয়ে যাবে। দেরি করা চলবে না, তাহলে কলার টেনে ধরবে। যত আস্তে আস্তে সব ঠিকঠাক হতে লাগলো, ফোনে খবর আসতে থাকে বিভিন্ন চেনা পরিচিত মানুষের থেকে। গৃহ সহায়িকা, খবরের কাগজ ওয়ালা, রাজমিস্ত্রি, ছুতোর মিস্ত্রি....একে একে সবাই জানাতে থাকে কারো ঘরের চাল উড়ে গিয়েছে, কারো ঘরের একপাশ ভেঙে পড়েছে আমগাছ পড়ে, কারো ঘর পুরোটাই ভেঙে গেছে, সাথে ধুয়ে গেছে ঘরে রাখা গচ্ছিত খাবার। ভাবলাম আহারে!এই ছিল তবে ঝড়??.... ফেসবুক আর ওয়াটস্ অ্যাপে ছবি দেখলাম, কলকাতা আর আশেপাশে অঞ্চলের ক্ষয় ক্ষতি, সুন্দর বনে মরে গেছে বেশ কিছু বাঘ, কটা আর বেঁচে আছে কে জানে? ভাবলাম........কিই সাংঘাতিক!!! এই ছিল তবে ঝড়??
       কয়েকটি ত্রাণ তহবিল আর চেনা কিছু মানুষকে কিছু টাকা খাবার, জামাকাপড় তুলে দিয়ে ভাবলাম দায় মিটিয়ে দিয়েছি। সুন্দর বন এলাকার কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছবি দেখলাম। করোনা আর ঝড়ের যুগ্ম দাপটে মানুষের দুর্দশা দেখা যায় না। এদের অনেকের কাছে নেই রেশন কার্ড। ফলে এই অসময়ে সরকারের থেকে অনেকেই পায়নি কম পয়সার রেশন। মাটির বাড়ি জলে ধুয়ে এক ধংস স্তুপের ওপর দিন কাটাচ্ছে ওরা অনাহারে, অর্ধাহারে। যে বাপ তার কোলের বাচ্চার মাথায় একটা ত্রিপল দিতে পারছে না, যে মা তার অভুক্ত সন্তানের মুখে ভাতের অভাবে কচুপাতা সেদ্ধ করে দিচ্ছে , সে কি আর কখনো ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে হাঁপাবে? এই সব ভাবছিলাম। হঠাৎ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফল আলাটার সামান্য অমনোযোগী অবস্থার সুযোগ নিয়ে  পথচলতি দুজন বাইক আরোহী চোখের সামনে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল তার পয়সার ব্যাগটা, সবাই হৈহৈ করে উঠলো, ছুটে গিয়েও নাগাল পেল না তাদের, কোথায় অন্তর্ধান হয়ে গেল। ফল ওয়ালার মাটির ওপর আছড়ে পড়ে কান্না দেখে কেউই হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারলাম না। অল্প অল্প সবাই কিছু হাতে তুলে দিলাম। ভাবলাম???......ঝড় দেখা আমার শেষ হয়নি। আজ আমাদের প্রত্যেকের উপর দিয়ে কখন কিভাবে ঝড় বয়ে যাচ্ছে হদিস কেউ রাখে না কেউ।  সব মানুষের মাথার উপর ঝড়টা আলাদা হয়।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours