শেখর রায়, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতা:

সেকুলার ভারতে হিন্দু মন্দিরকে দিতে হয় কর যেমন মুঘল আমলে হিন্দুদের ‘জিজিয়া কর’ দিতে হত। এই কর ব্যাবস্থা চালু হয়েছে পণ্ডিত নেহেরুর প্রধান মন্ত্রিত্বে স্বাধীন ভারতে ১৯৫১ সালে। মন্দিরের আয়ের ১৮% লেভি আর বাকি রাজ্য কর নিয়ে মোট ২৩.৫% নিয়ে চলে যায় রাজ্য সরকার। এর তীব্র বিরোধিতা করে তখন হিন্দুরা মাদ্রাজ উচ্চ আদালত ও সর্বোচ্চ আদালতে বিচার চায়। বিচারের রায় আবেদনকারির পক্ষে যায় এবং মন্দির থেকে এই তোলা আদায় বন্ধ হয়, কিন্তু সরকারী নিয়ন্ত্রণ থেকে যায়। পুনরায় ১৯৫৯ সালে তামিল নাড়ু বিধান সভা আইন পাস করে তদানীন্তন কংগ্রেসী কেন্দ্র সরকারের কাছে পাঠায় ও কেন্দ্র যথারীতি ঐ আইনের অনুমোদন দেয়। এই আইন প্রনয়নের প্রধান মদতদাতা ছিল খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারক শক্তি যাদের মূল কাজ ছিল হিন্দু দরিদ্র মানুষদের বিবিধ প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মান্তরন করা ও হিন্দু মন্দিরের শত শত একর ভূসম্পত্তি জবর দখল করা। এক তামিলনাড়ুতে বিগত ৭০ বছরে হিন্দু মন্দিরের ৪৭০০০ একর জমি খ্রিস্টান মিশনারিরা রাজ্য সরকারের সহায়তায় জবর দখল করে রেখেছে। সারা ভারতে এরা এমন কত হিন্দু মন্দিরের ভুসম্পত্তি জবর দখলে রেখেছে তার কোন বিচার নেই।  

হিন্দু সমাজে এইরকম ভাঙ্গন ধরিয়ে নিজেদের ধর্মীয় ফায়দা তোলাই ছিল ইংরাজ শাসকদের প্রধান উদ্দেশ্য। ভারতে তুর্কিস্থান আফঘানিস্তান ও আরব থেকে আসা মুসলিমদের শাসনে যেমন ইসলাম ধর্মে হিন্দুদের বলপূর্বক ধর্ম্যান্তকরন হয়েছিল, সেই এক ঔপনিবেশিক ইংরাজ শাসকের খ্রিস্টান ধর্মে ছলে বলে কৌশলে হিন্দুদের দেশের সর্বত্র ধর্মান্তরিত করার অভিযান চলে ও এখনো সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে দেশের বিভিন্ন প্রদেশে। সাথে চলছে হিন্দুধর্ম ও তার সনাতন মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি বিরোধী অপপ্রচার। ইংরাজ ঐতিহাসিকদের ও তার অনুরাগী দেশী ঐতিহাসিকদের দ্বারা প্রচারিত হয় যে আর্যরা ভিনদেশী আক্রমণকারী ও ভারত অনার্যদের দেশ যা সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্বিক গবেষকরা সর্বৈব ভ্রান্ততত্ত্ব বলে প্রমান করে। আর্যরা প্রশ্নাতীতভাবে ভারতীয় ও সিন্ধু সভ্যতার ধারাবাহিকতায় সর্বত্তম বৈদিক সভ্যতা ভারতে সর্বত্র প্রসার লাভ করে এবং বিশ্বে জ্ঞানে বিজ্ঞানে দর্শনে সাহিত্যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। বৈদিক সভ্যতায় কোন জাতপাতের ভেদাভেদ ছিল না, নারীর উত্তম মর্যাদা ও অধিকার ছিল। সমাজ বিকাশের স্বার্থে চতুরাশ্রম প্রথায় কর্ম অনুযায়ী বিভক্ত ছিল। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে তামিল নাড়ুতে শক্তিশালী খ্রিস্টান লবির মদতে  দ্রাবিড় (অনার্য) ও ব্রাক্ষ্মনের (আর্য) রক্তাক্ষয়ী সংঘর্ষে তামিল ব্রাক্ষ্মনদের অধিকাংশ রাজ্য থেকে বিতাড়িত হতে হয় ও রাজ্যে দ্রাবিড় নামে পার্টির শাসন প্রতিষ্ঠা পায় যা এখনো চলমান। এই আর্য অনার্য তত্ত্ব ও জাতপাতের বিভেদে সরকারি শিলমোহর লাগিয়ে চলেছে রাজনীতি ও দেশ শাসন। হিন্দু মন্দির নিয়ন্ত্রণ ও তার ধনরত্ন লুণ্ঠন এখনো একই উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়ে চলেছে।             
হিন্দু সমাজ ও তার মন্দিরগুলির উপর আক্রমনের সূচনা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন কালে ১৯২৫ সালে। কারন ব্রিটিশ বিতাড়ন আন্দোলনে মুলতঃ হিন্দু সমাজ অগ্রজ ভুমিকা নেয়। আর হিন্দুধর্ম ও তার ধর্মীয় স্থানগুলি ছিল সেই আন্দোলনের আধ্যাত্মিক শক্তি। তারই বদলা হিসাবে ভারতের ইংরাজ শাসক হিন্দু সমাজকে দুর্বল করে হিন্দু মন্দিরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের উপর আইনি আক্রমন চালায়, পাস করে হিন্দু মন্দির নিয়ন্ত্রন আইন। সমস্ত মন্দির কমিটি ও ট্রাস্টগুলিতে সরকারের প্রতিনিধিরা থাকবে এবং সমস্ত মন্দির কর্মকাণ্ডে সরকারী নিয়ন্ত্রণ থাকবে যেন হিন্দু মন্দিরগুলি কোন ভাবেই আর ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকাণ্ডের আস্তানা আর না হয়। আর একটি নোংরা উদ্দেশ্য ছিল ইংরাজদের সেটা ছিল মন্দিরগুলির রক্ষিত ভক্তদের দানে পাওয়া বিপুল ধনরত্ন লুণ্ঠন করা এবং সে কাজ তারা দক্ষতার সাথে করে বা চুরি করে ইংল্যান্ড প্রেরণ করে ও হিন্দু সমাজকে দুর্বল করে একই সাথে খ্রিস্টান ধর্ম যাজকদের ধরমান্তকরনের কুকাজকে সহজ করে। সেই ঔপনিবেশিক প্রভুদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নেহেরু সরকার ১৯৫১ সালে পুনরায় চালু করে ইংরাজ আমলের হিন্দু মন্দির নিয়ন্ত্রন কালা আইন।        
হিন্দু মন্দির নিয়ন্ত্রন আইনবলে সারা ভারতে সব রাজ্য সরকারগুলি তাদের মনোনীত ভিন ধর্মের প্রতিনিধি (খ্রিস্টান ও মুসলিম সহ) বসিয়েও হিন্দু মন্দির নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তারসাথে নিতে পারবে সারাবছর মন্দিরগুলির আয়ের এক তৃতীয়াংশ। অথচ গির্জা মসজিদ প্যাগোডা ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় স্থানগুলি সরকারি নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে থাকবে তাদের তহবিলের থেকে টাকা নেয়া দুরে থাক। দীর্ঘকাল ভারতে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর এই অন্যায় চলে আসছে যার কোন প্রতিকার নেই। ভক্তদের দানে যে তহবিল তিল তিল করে তৈরি হয়, যা দিয়ে মন্দিরের যাবতীয় রক্ষনাবেক্ষনের কাজ ও হিন্দু সমাজের কল্যানে খরচ করা হয়ে থাকে সে অর্থে তাদেরই অধিকার খর্ব করা হয়ে আসছে।  ভারতীয় আর্য সমাজের প্রধান স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী সরকারের মন্দির নিয়ন্ত্রণ আইন তুলে দেয়া ও রাজ্য সরকারের তোলাবাজি বন্ধ করার আপীল করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে তার আবেদনটি ২০১২ সাল থেকে এপর্যন্ত কোন সুনানি হোলনা অথচ মুসলিমদের তিন তালাক ও রাম মন্দির নিয়ে রায় বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে গেল কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে দেবার রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ। কারন এই মন্দির নিয়ন্ত্রণ বিরোধিতার বিষয়টি শাসক বিজেপির কর্মসূচীভুক্ত নয় এবং বহু রাজ্যে চলছে বিজেপি সরকার। তাই বিষয়টির উপর এদের তেমন কোন উৎসাহ নেই।      

আলোচ্য বিষয়টি অনেক কাল ধামা চাপা পড়েছিল। কেউ কোন সাড়াশব্দ করেনি। সম্প্রতি কেরালার সিপিএম মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন কেরালার গুরুবায়ুর দেবাশ্বম মন্দিরের কাছে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে ৫কোটি টাকা চেয়ে বসাতে আবার ইস্যুটি সামনে চলে আসে। কয়েকটি হিন্দু সংগঠন রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানিয়েছে যে দেশের একমাত্র সংখ্যাগুরু হিন্দু সমাজের প্রতি এই বৈষম্য অনতিবিলম্বে বন্ধ করুন। রাজ্য সরকারগুলির দ্বারা হিন্দু মন্দির নিয়ন্ত্রণ ও মন্দিরের অর্থ রাজ্য সরকারের দ্বারা অধিযাচন বন্ধ হোক। কারন ব্রিটিশ আমলের এই কালা কানুন কেন স্বাধীন ভারতে বাতিল করা হবে না ও কেন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার দেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ১৪ নং ও ২৭ নং ধারা অবমাননাকারি এই হিন্দু মন্দির নিয়ন্ত্রণ আইন এখনো বলবৎ রাখবে, কেন হিন্দু মন্দির থেকে তার ভক্তকুলের দানের অর্থের এক তৃতীয়াংশ রাজ্য সরকারগুলি রাজ্যের আইন প্রণয়ন করে নিয়ে নেবে? কেন হিন্দু সমাজের কল্যানে সঞ্চিত হিন্দু মন্দিরের অর্থে অন্য ধর্মীয় খাতে খরচের করা হবে, কেন চার্চ মসজিদ বৌদ্ধ মন্দির বাদ দিয়ে শুধু হিন্দু মন্দিরকে নিয়ন্ত্রণ ও জোর করে আইনের নামে তার ধন সম্পদ নিয়ে নেয়া হবে, কেন দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু মন্দিরে রাজ্য সরকারের স্বার্থে দেবদেবী টাকা দিয়ে দর্শন করতে হবে, কেন আদালতের আদেশ সত্তেও আজো বহু মন্দিরের স্থাবর অস্থাবর ধনসম্পত্তি দখল ও লুটপাটে দোষীদের সাজা  হোল না ইত্যাদি বহু বিবাদ ও অভিযোগের আজো কোন সুবিচার হয়নি।  বারংবার আবেদন নিবেদন করে যে কি লাভ হবে কেউ নিশ্চিত নয় কারন মোদী সরকার এখন করোনা নিয়ে ব্যস্ত।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours