প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

ইতিহাস কথা বলে;অম্বল হলো ব্যঞ্জন ; টক স্বাদের কোনো বিকল্প নেই। কোনো ফল সিদ্ধ করে তাতে মিষ্টি মিশিয়ে কিংবা না মিশিয়ে এই ব্যঞ্জন তৈরি হয়৷ রাঢ়ের বুকে শেষের ভাতে একটু চাটনি খুব উপাদেয়৷ নদিয়া, মুর্শিদাবাদে মরসুমি তরকারি হিসাবে অম্বল খাবার চল আছে। টক বলতে উপকরণ মানেই আম, টোম্যাটো, আমড়া, কাঁচা পাকা তেঁতুল, কুল, করমচা, টক পালং ইত্যাদির নাম পাওয়া যায়৷ বর্ধমান ও বীরভূমে পুরানো তেঁতুল দিয়ে মাছের টক রেঁধে তা মাটির হাঁড়িতে ভরে রাখা হয়। অনেক সময় রান্নাঘরের শিকেয় সাজিয়ে টাঙিয়ে দেওয়া হয়। বড়ো ওজনের পোনা মাছ বেশ কয়েকদিন রাখা হয়। এছাড়া চুনো, ল্যাটা, ফলুই মাছ দিয়ে টক রান্না করা হয়ে থাকে৷ 

বাংলা সাহিত্যে বিজয়গুপ্তের "মনসামঙ্গল " এ পাই, "শৌল মৎস্য দিয়া রান্ধে আমের অম্বল। " আর রাঢ়ের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর "চণ্ডীমঙ্গল " -এ খুল্লনার অম্বলে পারিপাট্যের সাজ ; " করিয়া কণ্টকহীন, আম্রে শউল মীন/ খর লুন দিয়া ঘন কাটি। " রাঢ়ের পৌষের বাউনি রীতিতে মূলো, বেগুন ও বড়ির টকের উল্লেখ আছে৷ তবে টক নাকি দূর যাত্রায় কখনই দেওয়া হয় না। কারণ কথায় আছে, টক, তাল, বড়ি, পিঠে নাকি অমঙ্গলসূচক। গ্রাম বাংলায় মায়েরা অঘটনের আশঙ্কাতে দূর যাত্রায় আহারে টক দেন না। 

সামাজিক ইতিহাসে খাদ্য সংস্কৃতির কথা এলেই মৌর্যযুগের খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের ব্রাহ্মী অক্ষরে লেখা দুর্ভিক্ষের দিনে রাজার আদেশ মনে পড়ে। সেই লেখোতে তিল, সর্ষে, ধানের কিছু কথা আছে৷ ধান থেকে উৎপন্ন যে ভাত তা বাংলায় আসে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে , তবে তা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে। "হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি ", বই থেকে জানতে পারা যায় যে,  চীন ও দক্ষিণ এশিয়াতে শুকনো মাটিতে ধান চাষ হতো৷ কিন্তু ভারতে জলে ডোবা মাটিতেই ধান চাষ হয়৷ আসলে ভারতের ভৌগোলিক পরিবেশ ধানের জন্য উপযুক্ত৷ সংস্কৃতে কালিদাসের " রঘুবংশ " কাব্যে ধান চাষের উল্লেখ আছে। বৈদিক সাহিত্যে, বৌদ্ধশাস্ত্রে, চরক সংহিতায় সরষের তেলের উল্লেখ আছে৷ মধ্যযুগে রুচি ও রসনার বোধ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবে ধরা পড়ে। 

যুগে যুগে নানা দেশের মানুষ ভারতে এসেছেন, বসতি গড়েছেন। থাকতে থাকতে রীতি নীতি, আদব কায়দা, তাদের সাথে থাকতে থাকতে বদলেছে। আসলে মেলবন্ধনের আরো এক নাম হলো ভারতবর্ষ। এমনকি স্মৃতিতে ফিকে হয়ে আসে অভিবাসনের ইতিহাস৷ তবে খাদ্য সংস্কৃতি কিন্তু পতুর্গিজ প্রভাবের ইতিবৃত্তটাই স্পষ্ট করে।   এইকথা স্পষ্ট করে বলতে গেলে আগে পর্তুগিজদের তিনটি স্তরের কথা বলতে হয়। একদম উপরের স্তর হলো সম্রাটের স্তর। ওদের ভাষায় " Fedalgo " রা বিপুল বিলাসবহুল সব প্রসাদে থাকতেন৷ দ্বিতীয় স্তর হলো " Soldados " ; সামুদ্রিক অভিযানে পটু পর্তুগিজরা যখন সোনার খোঁজে ব্রাজিল, উরুগুয়ে অভিযান করে, তখন তাদের অনেক মানুষের প্রয়োজন হয়। তখন পর্তুগালের সরকার ভিক্ষাজীবী, উদ্বাস্তু ও কারাগার বন্দীদের এই কাজে লাগাতো৷ পরে এরাই অবশ্য জলদস্যুতে পরিণত হয়৷ 
তৃতীয় স্তর ছিলো casados ; এরা উচ্ছৃঙ্খলতা ছেড়ে শান্তিতে জীবন যাপনে অভিলাষী ছিলো। কিন্তু রোমান ক্যাথলিক মহিলারা সমুদ্র পেরিয়ে দূর দেশে যেতে পারতো না৷ তাই কি আর করার!  এরা ভারতীয় মেয়েদের বিয়ে করে এখানেই থিতু হতো৷ এই ক্যাসাডোদের ভারতীয় গৃহকর্ত্রীরা ও অফিসার শ্রেণীর লোকেরা পাচক হিসাবে নিযুক্ত করতো। ১৫৩৭ এ বাংলায় পর্তুগিজদের পায়ের নীচে মাটি শক্ত হয়। চট্টগ্রামে কুঠি গাড়ার পর, সপ্তগ্রামে এরা বসবাস করতে শুরু করে। আকবরের ফরমানেই এরা ১৫৮০ সালে একটি নগরী পত্তন করে। তারপর তারা সরস্বতী নদীর  কথা মাথায় রেখে ,  সপ্তগ্রামের অনতিদূরে ভাগীরথীর তীরে " উগোলিম " স্থানে বসতি স্থাপন করে৷ এই উগোলিম হলো পাচক,আর চাকবাকেরেরা ছিলো মগ৷ 

পর্তুগিজদের একটি জনপ্রিয় খাবার হলো "carne de vinho e alhos "; carne মানে মাংস,  vinho হল
ওয়াইন,  " alhos "হলো রসুন। পরে ভারতীয় দের কাছে এটাই বিকৃত হয়ে  দাঁড়ালো " ভিন্দালহো " ; ভিনিগারে রান্না করার অর্থ এটা যেন পচে না যায়৷ কিন্তু  ভারতে ওয়াইনও পাওয়া যেতো না আর ভিনিগারও পাওয়া যেতো না৷ তখন অম্ল হিসাবে তেঁতুল ও গোলমরিচ দিয়ে একটা সস তৈরি করা হলো। ক্রমে তেঁতুল, তেজপাতা আর গরমমশলা হয়ে উঠল " গোয়ান ভিন্ডালু"। 

অম্ল যে সুলতানি আমল থেকেই জনমানুষের মন কেড়েছে তা একদমই সত্য৷ পুরুষ নারী উভয়ই অম্ল পছন্দ করেন৷  এমনকি অম্ল দুর্গার ভোগ হিসাবেই চলে৷ মাগুর মাছের টক ঝাড়গ্রামের আদিবাসী অধ্যুষিত চিল্কিগড়ের কনকদুর্গার মন্দিরে চল আছে৷ কিন্তু অম্ল রান্না নিজস্ব হলেও পশ্চিমভারতের নাম যে প্রকট তা অস্বীকার করা যায় না৷ প্রচলিত কথায় আছে " আইষ্টা ওঠাইতে চাই টক মিষ্টি চাটনি"। পৃথিবীর প্রাচীনতম খাবার হলো আচার। ২৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার সময় থেকে মানুষ আচার খাওয়া শুরু করে। পৃথিবীর প্রাচীনতম আচার হলো শসার তৈরি আচার৷ শোনা যায় নাকি রানি ক্লিওপেট্রা ও জুলিয়াস সিজার এই আচারই খেতেন৷ রানি খেতেন নিজের ত্বকের সৌন্দর্য রক্ষা করতে৷ ১৪৯২ সালে কলম্বাস নাকি আমেরিকা অভিযানের সময় নাবিকদের রেশন হিসাবে আচার দিতেন৷ ভিটামিন সি এর অভাব মিটিয়ে এই আচার স্কার্ভি রোগ নিরাময় করতো৷ চীনের ডিমের আচার ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে হাঙ্গরের মাংসের আচারের কথা জানতে পারা যায়৷ 

পরে অবশ্য এই অম্লের গুণ এবং খাদ্যের গুরুত্ব বিচার করে ২০০১ সালের ১৪ ই নভেম্বর দিনটিকে " আচার দিবস " বা "pickle day " হিসাবে পরিগণিত করা হয়। খাদ্যরসিক বাঙালি। আর বাঙলার সাথে সকল মানুষের কাছে বাহারি স্বাদে আচার সত্যিই অনন্য। হয়তো আরো অনেক জানার বাকি, তবু সামান্য নিবেদনে "অম্ল" এক অনন্য নির্মাণ যথার্থতা দান করে, এখানেই কালি কলমের সার্থকতা।। 

তথ্য সূত্র - 
১)ইন্টারনেট 
২)বিভিন্ন ব্লগ 
৩) ইতিহাসের কাল ও সময়ের সাথে খাদ্য 
বাঙালি খাদ্যকোষ 
৪) বাঙালি খাদ্যাভ্যাস প্রসঙ্গ 
৫)বাঙালির ইতিহাস 
৬) খাদ্যভ্যাসে পর্তুগিজ প্রভাব 
৭) বাঙালির রান্নার পর্তুগিজ 
৮) বাঙালির রন্ধনশিল্প, রাধা চক্রবর্তী 
৯) Indian Food : A Historical companion by  T Acharya. 
১০) উইকিপিডিয়া 
১১) হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours