সাগরিকা মুখোপাধ্যায়, লেখিকা, কলকাতা:

আজ ১লা এপ্রিল। নানা বয়েসে বিভিন্ন মজা দেখেছি এই এপ্রিল ফুল নিয়ে। কিন্তু এ বছর প্রকৃতি প্রায় মাস দুএক আগে থেকেই আমাদের বোকা বানাতে শুরু করেছে। মুশকিল হল, সেটা আর খেলায় নেই, একদম প্র্যাক্টিক্যাল জোক। তবে এই 'নিষ্ঠুর মজা' টা আমাদের অবধারিত ছিল।

মারা যাচ্ছে মানুষ। সংক্রামিত হচ্ছে মানুষ। পুঁচকে ভাইরাস, কতকটা ছোট বাচ্চাদের হাতে থাকা স্পঞ্জ বলের মতো দেখতে, সে কিনা অর্থনীতি থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ, অস্থিরতা, শান্তি --  কেড়ে নিয়েছে সব! ঈশ্বর শ্রেষ্ঠ সেরা জীব আজ ঘরবন্দী! এক থাপ্পড়ে চূর্ণ করেছে মানুষের দম্ভ!

ভূগোলের ছাত্রী। ভাইরাসের তেমন কিছু বুঝি না। তাও কৌতূহলে গুগলিয়ে সার্স, মার্স, এইচআইভি, ডিএনএ, আরএনএ, মাইক্রো ইভলিউশন, সেন্ট্রাল ডগমা, প্রোক্যারিয়োটিক - ইউক্যারিয়োটিক - আর্কিয়া ত্রিভুজ ইত্যাদি শব্দের মধ্যে খানিক ঘুরপাক খেলাম। মোদ্দা কথা বুঝলাম, জীব বিজ্ঞানের প্রতিটি পরিবর্তনের সুতো বিবর্তনের লাটাইতে বাঁধা। এবং ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা উষ্ণতা যা ৩০ হাজার বছরের পার্মাফ্রস্ট গলিয়ে সুমেরু অঞ্চলে কয়েকশ মিথেন গহ্বরকে হাঁ করিয়েছে, বেরিয়েছে শত শতাব্দী প্রাচীন ভাইরাসেরা। এই ভাইরাসকুল একেবারেই নিরীহ নয়, বরং গ্রীক মহাকাব্যের রহস্যময়ী মেডুসা বা আমাদের রক্তবীজের মত শক্তিশালী। এরা নামতার মত লাফ দেয় বহু গুন শক্তি বাড়িয়ে।

অন্য দেশের কথা ছেড়ে নিজের দেশের কথায় আসি।
বিত্তবানের বিতরণ করা ভাইরাস আক্রান্ত করছে সাধারণ মানুষকে, প্রান্তিক মানুষকে। বুঝে না বুঝে ছুঁয়ে ফেলছি মারন রোগ। আমার দেশের ৮৫% অসংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর কথা জানছি, যারা বাংলা, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খন্ড, উত্তরপ্রদেশ থেকে কেরালা, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, দিল্লিতে যায় পরিযায়ী ছন্দে। এই পরিস্থিতিতে তাদের না আছে খাদ্য, না আছে মাথায় ছাদ না আছে ঘরে ফেরার বন্দোবস্ত। আমার দেশ ভূমিকম্প, খরা, বন্যা, সুনামি, আয়লা মায় নোটবন্দী -- সব দেখেছে। ক্ষয়ক্ষতির সাথে সেখানে ছিল, ত্রাণ পাবার আশা। কিন্তু এ বিপদ সবার ঊর্ধে।

এবারের লড়াইটা একটু অন্যরকম। শিক্ষা বনাম অশিক্ষার, সচেতনতা বনাম অসচেতনতার, সততা বনাম অসততার ,স্বার্থপরতা বনাম স্বার্থহীনতার। আসলে প্রকৃতি একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে আমাদের, মানবতার চ্যালেঞ্জ।
 সমাজ মাধ্যমের বারোয়ারি আঙিনায় বোরডম কাটাতে আমরা নানা চ্যালেঞ্জ নিচ্ছি, ছুঁড়ে দিচ্ছি অন্যকে। আসলে এগুলো ওরমআপ ওই মানবতার চ্যালেঞ্জটাকে গ্রহণ করার, সরল করার।
এ সময় আমাদের শেখাচ্ছে অনেক কিছু, কেমন অজ্ঞাতেই জেনে ফেলছি নিজের কর্মক্ষমতা। দেখে নিয়েছি বিপদ কিভাবে এক করেছে 'দিদি - মোদি -সুজন -বিজন -সর্বজন' কে।
 নাসা বলছে ওজোন স্তরের ছেঁড়া-ফাটা সব রিফু হচ্ছে এই দূষণমুক্তিতে। শুধু ওজোন স্তর কেন, রিবুট হচ্ছে সম্পর্ক গুলোও। লকডাউনের শুরুতে ঘরে ঘরে ঝিকঝিক চললেও আস্তে আস্তে সবাই অভ্যস্ত হচ্ছি মিলেমিশে চলায়। ওর্ক ফ্রম হোম সামলে হোমওর্কও চলছে পুরোদমে, পুরো দস্তুর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। পরিচারিকাকে ফোন করে জানলাম  পানীয়ের অভাবে তার ঘরের পুরুষের 'বীর সিংহ' হওয়া থমকে আছে। দৃশ্য কল্পনা করতে ভাল লাগছে দরমা ঘেরা দাওয়ায়  সে জিরিজিরি করে বাধাকপি কুচচ্ছে, আটপৌরে স্বামী খিটখিট ভুলে হাতপাখায় বাতাস টানছে।

কি হতে চলেছে জানা নেই। কিন্তু আশা করতে, প্রত্যয়ী হতে, বিশ্বাস করতে তো বাধা নেই। বেঁচে থাকতে গেলে বাঁচতে হবে পজিটিভলি। 'দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না'।
করোনায় মৃত্যু-সংখ্যা আর আক্রান্তের সংখ্যার বদলে দেখছি সুস্থতার সংখ্যা। দেখছি ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবন বিপন্ন করে সেবা করার মরণপণ চেষ্টা, যার শরিক আমার সাগরপাড়ের প্রিয় ডাক্তার বন্ধুও। দেখছি মানুষের পাশে দাঁড়ানো স্বেচ্ছাসেবীদের প্রয়াস। দেখছি ঘরে বাইরে সাধারণ থেকে তারকা সবার অর্থ সাহায্যের বাড়িয়ে দেওয়া হাত।

আশা জাগছে, পারব আমরা। ফিরব আবার --  ঠিক যেমন করে ছাদের কোণে মৃতপ্রায় গাছটা মেলে ধরতে চাইছে নিজেকে, ফিরে আসতে চাইছে জীবনে।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: