দীপ্তেন্দু চক্রবর্তী, প্রবাসী লেখক, টরোন্টো, কানাডা:

বাঙালিরা প্রথমে আসে ব্রিটেনে। ব্রিটিশরা বাঙালি বাবুদের ইংরেজি কায়দা কানুন, দপ্তর চালানোর জন্য বাঙালিদেরই বেশি পছন্দ করতো। যার কারণ ছিল কলকাতা ভারতের রাজধানী আর বাঙালিরা সেরা কেরানীকুল। এখন বিশ্বের সব বড় শহরে বাঙালি বাস করে। লন্ডন, নিউইয়র্ক, সিডনি, সানফ্রান্সিসকো, টরন্টো এখন বাঙালিদের বাসস্থান। ইটালি এখন বাংলাদেশীদের দ্বিতীয় দেশ। পুরো বাংলাদেশী পাড়া এখানে আছে ঠিক লন্ডনের মতো। ইউরোপের যেখানে আপনি যাবেন দেখবেন বাংলাদেশিরা রাস্তায় নানা রকমের জিনিস বিক্রি করছে। এদের অনেকেরই থাকার ভিসা নেই তবুও পালিয়ে এসে থেকে যায়। একটা ঘরে দশ জন মিলে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি খুব একটা পাবেন না। বিদিরা বিশেষ করে সিলেটিরা লন্ডনের ইন্ডিয়ান রেস্তোরা কব্জা করে ফেলেছিলো ষাটের দশক থেকে। তারপর পাঞ্জাবিরা এখন বিশ্বের বহু ইন্ডিয়ান রেস্তোরার মালিক। বিদিদের সেলাম জানাই। ঘর বাড়ি জমি বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি দিয়ে চলেছে পঞ্চাশ দশক থেকে। মনে আছে আমি তখন জাহাজে করে ইরানে আসছি মুম্বাই থেকে। করাচি পার হবার পর একজন ছেলেকে পাওয়া গেলো ইঞ্জিন রুমের পাশে তেলের ড্রামের মধ্য লুকিয়ে ছিল। ব্রিটিশ জাহাজ।জাহাজের কেউ ওর ভাষা  বুঝতে পারছে না। ষোলো বছরের এক বাংলাদেশী ছেলে করাচি থেকে লুকিয়ে জাহাজে উঠে পড়েছে। ক্যাপ্টেনের ঘরে অঝোরে কেঁদে চলেছে। আমি কান্নার ভাষা শুনেই বুঝলাম ঢাকার মতো উচ্চারণ। আমি দোভাষীর কাজ করলাম। বাবার জমি বেঁচে সে এখন লন্ডনে খালার কাছে যাবে। পাসপোর্ট আছে কিন্তু কোনো ভিসা নেই কোনো দেশের। মাস্কাটে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলো। কত এরকমের পালানো লোক দেখছি। বসন্ত বাংলাদেশের চিটাগাংএর মানুষ। সে লুকিয়ে নানা দেশ ঘুরে জার্মানি থেকে পাহাড়ের টানেলের মধ্য দিয়ে প্যারিসে আসছিলো। ধরা পরে গেলো পুলিশের হাতে এবং পাঠিয়ে দেওয়া হলো বাংলাদেশে। সেই বসন্ত আবার ঢুকে পড়লো প্যারিসে।আমাদের অসীমদা ওকে নানা ভাবে সাহায্য করে। সেই বসন্ত ইতালিতে গিয়ে ভিসা নিয়ে দিব্বি পিসার কাছে আলবা বলে একটা শহরে আছে। বিরাট ফ্লাট, বৌ ছেলে সব নিয়ে এসেছে। বড় ছেলে ইতালিয়ান সকার টিমে নাম করা খেলোয়াড়। আমরা গিয়েছিলাম ওর বাড়িতে।খুব আদর যত্ন করেছিল আমাদের ।ওরা পার্বত্য ভাষায় কথা বলে। খানিকটা আরাকানদের মতো। হিন্দু।
লন্ডন, টরন্টো, নিউইয়র্ক বা যে কোনো শহরে বাঙালিরা নিজেদের ক্লাব করে নিয়েছে। কালীবাড়ি, ক্লাব, দলাদলি, সব সঙ্গে এনেছি আমরা। সবারই নিজস্ব বন্ধু বান্ধব বা দল থাকে। আমি বহু মানুষ চিনি কিন্তু আমার বন্ধুর সংখ্যা হাত গোনা। সবার সাথে বন্ধুত্ব করা যায় না।তা ছাড়া আমার সমস্যা আছে সবার সাথে আড্ডা মারতে, খাওয়াতে। বহু বাঙালি লাল মাংস খান না, সূরা পান করে না। সেখানে আমি নেই। শনিবারের পার্টিতে ডেকে উনি চিকন আর চারা পোনার ঝোল খাওয়াবেন।আর রান্নাঘর থেকে মধুপক্কের বাটিতে করে একটু বাজে মদ দিয়ে আমাকে ভালোবেসে বলবেন- তুমি তো আবার গাড়ি চালাবে?- একেবারে ওইসব বাড়িতে আর যাই না। আমেরিকা ইউরোপে বাঙালিদের খাবার স্বর্গ। কী চাই আপনার? কুমড়ো, ঢ্যাঁড়স, পুঁই শাক, লাল শাক, রুই কাতলা, ইলিশ, ট্যাংরা, পুটি, পাবদা, চিতল কি চাই। সব আসে বাংলাদেশ থেকে ফ্রজেন। ভারত থেকে আসে চাল, ডাল, মসলা, পাঁপড়, উচ্ছে, আম। আমে ভর্তি এদেশ। যদিও দেশের আমের খুব দাম। আটটা চৌসা বা ল্যাংড়া পনেরোশো টাকা। সেখানে মেক্সসিকান আমের বারোটার বাক্স ৫০০ টাকা। আমাদের বাড়িতে খুব একটা দেশের মাছ আসে না। আমরা কানাডিয়ান স্যামন, গলদা, চিংড়ি খাই। কড, হ্যাডক, সোল্, হালিবাট, গ্রুপের, রেড স্ন্যাপার, ঝিনুক, স্কুইড খুব খাই। অবশ্য আমার কথা ধরবেন না। আমি কুড়ি একুশ বছর বয়স থেকে এদেশে। ধরিকা কুত্তা না ঘরকা না ঘাটকা। আধা সাহেব শুধু বাংলাটা ভালো জানি আর টাই পরে মাছের বাজারে যাই না। উফফ যা বাঙালি যন্ত্রর আছে না এখনো? এক সাহবে সুনীলদার বাড়িতে এসেছে। সুট টাই পরা। কথায় কথায় জানালেন যে উনি দেশের খাবার খান না। সব ভেজাল। জার্মানি থেকে টিন ফুড নিয়ে আসেন। এখানকার চাল, ডাল খাবার সব খারাপ।আমার কি আনন্দ? -স্যার আপনার সঙ্গে আমার খুব মিল আছে। আমিও নেটিভদের খাবার স্পর্শ করি না।আমিও টিন ফুড এনে থাকি কানাডা থেকে।- সুনীলদা পেছন থেকে কটমট করে তাকাচ্ছে।- স্যার আমি তো তাজ বেঙ্গলে ব্রেকফাস্ট করি রোজ, কাল থেকে আপনাকে তুলে নিয়ে যাবো- শুনে সাহেব খাবি খায়।থাকে যাদবপুরের কলোনিতে। আর কলকাতায় এসে ঢপের লবচপানি? কি মজাই না হয়েছিল। ভালো থাকবেন। (ক্রমশঃ)

(ছবি প্রাপ্তি: প্রতিবেদক। ছবিতে প্রয়াত সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে বসে রয়েছেন প্রতিবেদক।) 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: