জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার ও চিত্রশিল্পী, কলকাতা:

বিশ্বব্যাপী এই বিপর্যয়ে আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও অর্থনীতির চৈত্রমাস তথা সর্বনাশ হলেও পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের পৌষমাস। নির্বিঘ্ন সমুদ্রের তীরে খেলা করে যাচ্ছে নীল ডলফিন, পরিযায়ী পাখির কাকলিতে বসন্ত সুরঙ্গম, নির্মল আকাশে ঢেউ খেলাচ্ছে সবুজ প্রাণবায়ু - পরিচ্ছন্ন হচ্ছে জননী বসুন্ধরা। চতুর্দিকে নৈঃশব্দের সাধনা। কী অপূর্ব অভূতপূর্ব এই জাগতিক দৃশ্য! ভোগ, বিনোদন, বিলাসিতার মেদ ঝরিয়ে জীবনের সহজ ও আবশ্যক প্রয়োজনীয়তার বৃত্তে আবদ্ধ হতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। প্রকৃতির কড়া চাবুক এসে পড়েছে স্বঘোষিত সভ্যতার পৃষ্ঠদেশে। বিপর্যয়ের কান্নার পাশাপাশি ঝলসে উঠছে নৈসর্গিক উচ্ছাস। কী মহিমাময় এই সহাবস্থান।

তিল তিল করে ঘরের মধ্যে ঘর গড়ে তুলেছি আমরা। অসংখ্য দেওয়াল। কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান, কেউ বিজেপি কেউ তৃণমূল কেউ কংগ্রেস কেউ সিপিএম, কেউ মোহনবাগান কেউ ইস্টবেঙ্গল, কেউ আমেরিকা কেউ ইউরোপ, কেউ অগ্রসর কেউ অনগ্রসর, কেউ ধনকুবের কেউ ভিখারী, কেউ গোরাচাঁদ কেউ কালাচাঁদ। সব দেওয়াল আজ ভাঙছে। যদিও এখন‌ও পারস্পরিক দলীয় ও জাতিগত ঘৃণা, নিজেকে উৎকর্ষ ও অপরকে হেয় প্রমাণ করার খেলা চলছে। এই দুর্যোগে নিজে কিছু না করা কিছু মানুষ মেধা ও পাণ্ডিত্যে সহস্র যোজন দূরে থাকা অমর্ত্য সেনকে 'বুড়োভাম' বলতে বা বিদ্বজ্জনদের গাল পারতে ছাড়ছেন না (ভদ্রতা ও শালীনতা বজায় রেখে ব্যক্তি আক্রমণ বা কুৎসা না করেও যে যুক্তি দিয়ে সমালোচনা করা যায় সেই বোধটি এখনো করায়ত্ত নয়)। কিন্তু তবুও দেওয়াল ভাঙছে। আরো ভাঙবে। যেদিন বিদ্বেষ বৈষম্য প্রভৃতি পৃথকীকরণের বেতনভুক সকল সৈন্যরা  কোয়ারানটাইনে চলে যাবে সেই দিন সব দেওয়াল তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। আজ তার সূচনা হয়েছে। আজ প্রাণ বিপন্ন তাই সবাই শুধুই মানুষ। ওপরের পলেস্তারা খসে পড়ছে। তেঁতুলপাতার তলায় এসে দাঁড়িয়েছে পরস্পর পরস্পরকে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করা মানুষ। ঠুনকো বেড়া মড়মড়িয়ে গুড়িয়ে যাচ্ছে। কাঁটাতার দিয়ে মানুষ আটকাতে চাওয়া মানুষ আণুবীক্ষণিক কীটাণু আটকাতে ব্যর্থ হচ্ছে। অদৃষ্টের কী মধুময় পরিহাস।

রবীন্দ্রনাথ চিরকালই লিখেছেন বিশ্বভ্রাতৃত্বের কথা। আজ পরিস্থিতি আমাদের সেই অমোঘ বাণীতে ছায়াচ্ছন্ন হবার শিক্ষা দিচ্ছে। এত যে মারণাস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র, সৈন্যসামন্ত সব তুচ্ছাতিতুচ্ছ আজ। অথচ মানুষকে অভুক্ত অর্ধভুক্ত রেখে সেই অন্নেই আমরা পরিপুষ্ট করে এসেছি প্রতিটি ঘরের প্রতিটি দেওয়ালের প্রতিরক্ষা। আজ আমাদের লজ্জিত হবার দিন, অনুতপ্ত হবার দিন, শিক্ষিত হবার দিন।

অনেকে এই সুযোগে ও সময়ে ঈশ্বরবিশ্বাসীদের কাছে গুরুতর প্রশ্ন রাখছেন - ঈশ্বর কী করছেন আজ। বোধহয় ঈশ্বরবিশ্বাসীদের আক্রমণ করার একটা পড়ে পাওয়া সুযোগ পাওয়া গেছে। আচ্ছা, আমি যখন বাজারে গিয়ে জ্যান্ত মাছ বা মুরগিটা কাটিয়ে আনি তখন তো ঈশ্বর আমার হাত থেকে ঐ মাছ বা মুরগিকে বাঁচান না, তবে, আজ তিনি ভাইরাসের হাত থেকে আমাকে বাঁচানোর দায় নেবেন কেন। বাঁচানোর দায় তার থাকলে মৃত্যুর দায়‌ও তো তার‌ই। আর ঈশ্বর কে? কারা? ঈশ্বরের সহজ সংজ্ঞা স্বামী বিবেকানন্দ দিয়ে গিয়েছেন কবেই। জীবাত্মাই হলো ঈশ্বর। জীবে প্রেম, জীবে সেবাই ঈশ্বরসেবা। কাজেই সম্পদেই হোক বা বিপদেই হোক, যা করার মানুষই করবে এবং তাকেই করতে হবে। স্বামীজি পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানচেতনা, চর্চা ও প্রয়োগকে গ্রহণ করতে বলেছেন একাধিকবার। এবং সেই বিজ্ঞানকে ভর করেই আজ যা করার সেটি করতে হবে।
একটি বিষয় স্পষ্ট করে মনে রাখা দরকার যে বিজ্ঞান যুক্তি ও প্রমাণনির্ভর কিন্তু ঈশ্বর একান্ত‌ই বিশ্বাসনির্ভর। বিজ্ঞান প্রমাণনির্ভর বলে সেটিকে মানতেই হবে এবং তার ওপর নির্ভর করতেই হবে। ঈশ্বরের ওপর কেউ বিশ্বাস রাখতেই পারেন। এটি তার ব্যক্তিগত জীবনদর্শন। তার‌ও নানা প্রকারভেদ আছে -সাকার, নিরাকার,দ্বৈত, অদ্বৈত। যত মত তত পথ। ঈশ্বরবিশ্বাস বিজ্ঞানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নেই। বিজ্ঞানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার। গোবর গোমূত্র অস্বাস্থ্যকর ধর্মসম্মেলন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, প্রচারসর্বস্ব, অসৎ, ভন্ড, লম্পট, ফতোয়াবাজ, মাফিয়া, মৌলবাদী, ধর্মান্ধ, তথাকথিত ধর্মগুরুদের ভড়ং এর সঙ্গে ঈশ্বরবিশ্বাস, ধর্মচেতনা বা আধ্যাত্মিকতার কোন‌ও সম্পর্ক নেই। ধর্মকে নিয়ে যেমন ভন্ডামি হয়, বিজ্ঞানকে নিয়েও কম ভন্ডামি হয় না। অনেক তথাকথিত চিকিৎসক, অনেক তথাকথিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, অনেক তথাকথিত ঔষধ প্রস্তুতকারী সংস্থা সংঘবদ্ধভাবে আঁতাতের মাধ্যমে অনেক তথাকথিত ধর্মগুরুর মতোই বিশুদ্ধ ভন্ডামি করে সর্বসাধারণকে ধনে-প্রাণে-আবেগে-বিশ্বাসে সর্বসান্ত করে চলেছে। পার্থক্য একটিই আর সেটি হল, ঈশ্বরবিশ্বাসী না হয়েও এবং একান্ত বিজ্ঞানমনস্কতা বজায় রেখেও বহু মানুষ এই বি‍জ্ঞানকেন্দ্রিক ভন্ডামির শিকার হচ্ছেন। কাজেই ঈশ্বরবিশ্বাসীদের প্রতি এই অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় আক্রমণ বাঞ্ছিত নয়।

এটি মানতেই হবে যে,  প্রকৃতি তার আপন নিয়মেই চলে। সে নিজেই তার নিজের ভারসাম্য বজায় রাখে। সময় নিজের কালচক্রে এগিয়ে চলে। প্রকৃতিগতভাবেই সৃষ্টির মতো বিনাশ‌ও কালচক্রের ধর্ম। মহামারী, দুর্ভিক্ষ না থাকলে হয়ত আজ ভারতবর্ষের জনসংখ্যা হতো পাঁচশ কোটি। সেটি কি অভিশাপ হতো নাকি আশির্বাদ? খন্ড সময়ে খন্ড সত্যে যা অভিশাপ, পরবর্তীকালে সেটি‌ই আশির্বাদ। সক্রেটিস বলেছিলেন, জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার হলো মৃত্যু। আমাদের বুক ভেঙে গেলেও এই বাস্তব সত্যকে স্বীকার করতেই হবে। এই অতিমারী আমাদের এই সময়ের বহু সহনাগরিকের প্রাণ কেড়ে নেবে‌। আমাদের স্বাভাবিক জীবনচর্যা ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত হবে। পৃথিবীজুড়ে যে ক্ষতি হবে, বহু বছর লাগবে সেই ধাক্কা সামাল দিতে। পরিস্থিতির থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ যদি মারণাস্ত্র আর সামরিক অপচয় ব্যপকভাবে কমাতে পারে তবে শীঘ্রই এই ঘাটতি পূরণ কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।

মানুষ জগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। এই ভাইরাসের নিরাময় বা চিকিৎসা হয়ত অদূরেই। এখনও চিকিৎসায় ইতিবাচক সাড়া মিলছে প্রথাগত ঔষধপত্র ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই। বিশ্বজুড়ে অন্ততঃ পনেরোটি ঔষধের ট্রায়াল চলছে। আশা করা যায় দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে প্রতিষেধক খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে। তবে আজকের প্রবণতা ততদিন বজায় থাকলে পৃথিবীর জনসংখ্যা ও জনস্বাস্থ্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটি ভাবনার অতীত।

কিন্তু তবুও, আমরা ফিনিক্স পাখি হবো। আমরা নিরাশ বা হতাশ হবো না। আমরা করবো জয়, আছে প্রত্যয়। ধর্মরাজের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে যুধিষ্ঠিরের উত্তর আমাদের অজ্ঞাত নয়। জীবন নতুন করে অনিশ্চিত হয়ে পড়েনি। সেটি সর্বদাই অনিশ্চিত ছিল, আছে ও থাকবে। আমরা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সেই সত্যকে নতুন নতুন করে আবিষ্কার করে চলি মাত্র। কাজেই আমরা যথাসম্ভব সতর্ক থাকবো, সচেতন থাকবো, সতর্ক করবো, সচেতন করবো এবং পরিস্থিতির ওপর নজর ও আপৎকালীন প্রস্তুতি রাখবো। এবং এক‌ই সঙ্গে আসুন, আমাদের জীবনের যথাসাধ্য স্বাভাবিকতা বজায় রেখে 'বিগতস্পৃহা' ও 'অনুদ্বিগ্নমনা' থেকে ক্ষণিকের জীবনে আনন্দের সন্ধান ও উপভোগ গতিশীল রাখি। 'কোথা হা হন্ত চিরবসন্ত, আমি বসন্তে মরি' - এই আক্ষেপ নয়, শিমুলের পলাশের জারুলের বসন্তকে সর্বাঙ্গে লেপন করে নেই।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট জীবনের প্রভূত বসন্ত কাটিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। ভুবনবিজয় ছিল তার দুঃস্বপ্ন বা দিবাস্বপ্ন ‌ একবার এক যুদ্ধের সময়ে তিনি তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে চলেছেন ইউরোপের অরণ্যপথে। রাতের নিকষ অন্ধকারে হঠাৎ‌ই গেয়ে উঠলো একটি নাইটিঙ্গেল। নেপোলিয়ন চিৎকার করে সকলকে থামালেন। বললেন থমকে যেতে। বললেন, 'যুদ্ধ চলতেই থাকবে, কিন্তু এই নাইটিঙ্গেলের গান আমরা আর হয়ত কখনো‌ই পাবো না'‌।

করোনা আমাদের সব হিসাব ওলটপালট করে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে হিসাব মিলিয়ে জীবনের সব কিছু নির্ধারিত হয় না। আমরা নির্মেদ হবার, সবুজ হবার শিক্ষার সুযোগ নিয়ে জীবনের এক অভূতপূর্ব ও দুর্লভ অবকাশে উন্মুক্ত হয়ে আছি। এ সুযোগ একাধিকবার আসে না। আমরা সেই বিরলতম সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের দিগন্তরেখায় মেঘের মতো ভেসে চলেছি।( শেষ)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: