প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

আমার সংসারে প্রতিশোধের প্রতিক্রিয়া কি কেবলই দূর্যোধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ!  অদ্যবধি পুষে থাকা অসুখে কি সূর্যাস্ত ছিল না!  প্রতিহিংসায় ভীম কি চক্রের বাইরে রেখেছিল কুন্তী, যুধিষ্ঠির, বিদুরকে।  হ্যাঁ, ছিল একান্তভাবেই সংযত। তবে কি তাঁরা  সংযত প্রচেষ্টা করেছেন চিরকাল!! তবে যে যুদ্ধ বিজেতা বা বিজয়ী পরিণাম!  না,  যুদ্ধের একমাত্র ফল হলো ধ্বংস। এ তো আত্মতুষ্টির কারণ হতে পারে না।  অগণিত মানুষের নিহত প্রতিহিংসা, প্রতিদিন দশ হাজার নির্দোষের মৃত্যু, ভীষ্মের প্রতি অস্ত্রাঘাত, জ্ঞাতি দ্বন্দ্বের বিরোধিতা, সবটুকু ছিল নিধন পর্ব। আমরা তো চায়নি এই যুদ্ধ হোক৷ কৃষ্ণ, তুমি পুরুষোত্তম; তোমাকে চেতনার গভীরে ভূর্জপত্র দেবো এ কি আমার সাজে বলো!  তবু তুমি তো শান্তি আনতে পারতে। তুমি কি তবে মূল হোতা ছিলে!  এ তো মোহজাল, যেখানে অজ্ঞানতার অভাবে জড়িয়ে পড়েছে দ্বন্দ্ব। মা বলেছিলেন, কৃষ্ণ এককভাবে কুরু রাজ্য বিভক্ত করার সপক্ষে  মত দিয়েছিলেন। নিরপেক্ষ বিচারে যুদ্ধ সকলেরই কামনা৷ কৃষ্ণ আসলে বুদ্ধিমান ; কৌশলী এবং নেতৃত্বে পরিপন্থী। তিনি জানতেন সংসারে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়, আর মহাকাল সবকিছুকেই জীর্ণ করে ফেলবেই। আত্মম্ভরী শাসকেরা হতাশায় আকুল হন,কারণ তাঁরা প্রকৃত সত্যকে বোঝেন না।। কেউ আমাকে শেষ তত্ত্বের সন্ধান দিতে পারেননি। তাই প্রশংসা বা নিন্দা একান্তই অর্থহীন৷।

আজ আর শোকক্লিষ্ট ভাব আসে না। আমাদের  ছিল পুত্রস্নেহান্ধ ভাব ; রাজ্যকামুক ও পররাজ্যলিপ্সা ; আমি পেয়েছি শাস্তি, প্রকৃতিপুঞ্জ থেকে আজ প্রজারা সুখী। বিদুর সজ্জন ছিলেন। তাঁর অভিযোগ  বহুবার সূর্যাস্তের রঙে মিশে গেছে স্নেহান্ধের বুকে। ধৃতরাষ্ট্রের  কাছে পাণ্ডবেরা সন্তানতুল্য। কিন্তু দূর্যোধন যে তাঁর শরীর থেকে জাত। ভীম বরাবর জ্ঞাতিদ্বন্দ্বের দীর্ঘ পরম্পরাকে ভুলতে বসেছিলেন। আমি দূর্যোধনের ধূর্ত ও কৌশলী ভাবকে অস্বীকার করতে পারি না৷ মা আমি, কিন্তু বিষবৃক্ষের ইন্ধন যোগাতে চাই নি। আত্মঘাতী, দ্বন্দ্ব, ভাতৃঘাতী আমার ইপ্সার বিষয় ছিলো না। কবে মানুষ বুঝবে সে কথা - ধ্বংস নয়, নির্মোহ চিন্তন।।

কি দিয়েছে এই নিধন বিষন্নতা!  দূর্যোধনের স্ত্রী ভানুমতী আজও ভীমের দ্বারা অথবা তার আদেশে অন্যদের থেকে ধর্ষিতা হবার আশঙ্কা পায়। বিকর্ণের স্ত্রী নিতান্তই যুবতী। কোপন ভীম আজও ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে তুলেছে। তবে কি এই নারীদের আত্মহত্যাই শেষ পরিণতি হবে!  এই কি প্রজন্ম বিধি। আজ তো বিবেচনায় আর ধৃতরাষ্ট্র নেই। সমাজ জুড়ে বিভীষিকাময় যে ধর্ষক কাহিনি তা কি অদৃষ্ট ভাবতে হবে!  ভীম আজও ভোলে নি দুর্যোধনের বাম উরুতে চপেটাঘাত আর দম্ভের আদেশ। দুঃশাসনের সেই কেশাকর্ষণ আজও ম্লান হওয়ার নয়৷ আজ আমার কষ্ট বিধবাদের জন্য। আমি চাইনা আমার এই দুঃখের সাথী হোক কুন্তী। যদিও কুন্তী মানতে চায় না, যে, এই ছেদ বিপর্যয়ের৷আমার  সঙ্গে এলেন কুন্তী, বিদুর, সঞ্জয় ;
আজ আমি বানপ্রস্থী ; আমার আজ আর অধিকার নেই এতো কথা বলার ; নিদ্রাকর্ষণ করে না আজ ; কথাবার্তা বন্ধ করে নির্বাক থাকলেও মন বিবিধ ভাবনার তাড়নায় ভোগে৷ আজ আমি কেবলই অনুগামী।
আজ আমরা দুই সখী অদৃষ্টের দাস ; আমি চেয়েছিলাম তাঁর সাথে থাকতে। মা ক্ষেমাংকরী আমায় যত্ন সহকারে কুন্তীর থেকে আলাদা করে রেখেছিলেন ; আমি আমার স্বামীর অন্ধত্বকে ভালোবাসতে বাসতে, কবে তাঁর পরিবারকে ভালোবেসে ফেলেছি জানি না। আমার মানসিক অভিমান গড়ে উঠেছিল তাঁর উপর; আমি বুঝিনি আমিও রাগ করতে পারি, আমারো মন আছে ; আমারো অভিযোগ আছে,আমারো ভালোলাগা আছে ; কিন্তু মহারাজকে অতিক্রম করতে পারলাম কই!  কুন্তী তোমার পাণ্ডু তোমার যৌবনের অনেকটা সময় তো মাদ্রীর সাথে কাটিয়েছেন। স্বাতন্ত্র‍্যপ্রিয় হলেও মর্যাদার কার্পণ্য তুমিও তো করো নি। তুমি যে বিদুরকে ভালোবাসো, এ আমি জানি। তাই শেষ অবধি আমি তাঁকে সঙ্গে রাখবো। যুধিষ্ঠির তো তাঁরই সন্তান। আমি তো তোমার দোষ দেখি না। তুমি যে, আত্মার আত্মীয়রূপে কাউকে পাওনি, সেখানে আমিও দায়ী।

আজ কুন্তী তাপদগ্ধ, হতাশ কারণ সে যে কর্ণকে হারিয়েছে৷ আমিও শতপুত্রকে হারিয়েছি ; কুন্তী আমাকে অনুনয় বিনয় করেছে, এই মৃত পুত্রদের যেন আমি একবার দেখি৷ আমার উন্মুক্তচক্ষে  আমি তো বিশ্বপ্রকৃতি দেখি নি,আজ অভাগীর  প্রাসাদে দেখবো মৃত সন্তান।আমি তো সর্বহারা নারী৷ কিন্তু আমার মানসিক ব্যাধি থেকে আমিও মুক্ত হতে চাই৷ আমার উন্মুক্ত চক্ষুর দ্বারে ভুঁড়ি ভুঁড়ি অন্ধকার মেপে নিচ্ছে দুঃখ৷ প্রকৃতির সাহচার্যপ্রাপ্ত অবয়বী হয়ে শীতল চন্দন প্রলেপে আমি ছুঁলাম জীবন৷ নিসর্গ তো শান্তির উৎস,  আমার নিঃসঙ্গতা জুড়াবে কি!! আমি ফিরে গেলাম আশ্রমের কোলে। মারণ ব্যাধি ধরে আছে বুক জোড়ায়, আত্মনিমগ্নতা ভালো লাগছে আমার৷ চিত্তশুদ্ধিই তো বৈখাবস ধর্মের মূল কথা৷ আজ কুন্তী আমাকে বোঝালেন কেন তিনি কর্ণ কে মেনে নেন নি৷ সুত আর রাধার উপর অবিচার করতে পারেন নি তিনি৷ আর দুর্যোধন কর্ণকে সব দিয়েছিল, তাই, তাঁকে নিজের দলে নিলে দূর্যোধনের  উপর অবিচার করা হয়, তাই অব্যহতি চেয়েছেন বার বার৷ বিপথগামী হতে গেলে প্রতিপক্ষ প্রয়োজন,মনে হয় ধৃতরাষ্ট্র জুড়েই ছিল সেই কুচক্রীর আসর৷।

আজ পরিসমাপ্তি কাল উপস্থিত। সম্মুখে বীচিক্ষুব্ধ ভাগীরথী মিলেই আছে মোহবিস্তারে উন্মোচনের পটভূমি। প্রাক্তনদের শরীর নেই, কেবল নিবিষ্টের আত্মনিবিষ্ট মায়া দর্শন। আজ আমি ফিরে যাচ্ছি নিয়তির পোষাকি শোক বয়ে। আত্মস্থ হবো আমি, প্রত্যাবর্তনে আমার কর্তব্য কর্ম। আমার সাথে ফিরলেন না শত পুত্রবধূরা। তাঁদের আর সংসারে ফেরা হলো না। শ্রোতা দর্শকে আমি নিদ্রামগ্ন আজ। ভীম বললেন ঋষি প্রকৃত নির্দয় ; কুল আর কালের শুদ্ধতায় সলিল সমাধি ঘটালেন। ভূমি শূণ্যে আর হাহাকার রইল না, শুদ্ধি পড়ে রইল আয়োজনে নিরন্তর৷

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours