সুলগ্না দাশগুপ্ত, লেখিকা ও অর্থনীতি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো, আমেরিকা:

কবীর সুমনকে বাংলা উত্তরআধুনিক গানের জনক বলা চলে। আধুনিক বাঙ্গালী জীবন থেকে উঠে আসা গান, সম্পূর্ণ নতুন সুরের ধাঁচে নির্মিত, যাকে অনেকে "জীবনমুখী গান" আখ্যা দিয়েছেন (যদিও কবীর সুমন নিজে তাঁর গানকে জীবনমুখী বলে বর্ণনা করেন নি কখনো) - সেই সম্পূর্ণ নতুন ধারার আধুনিক বাংলা গানের স্রষ্টা কবীর সুমন। আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলব -  তাঁর গান থেকে সুরকে বাদ দিলে যা পড়ে থাকে তা হল অনবদ্য কবিতা। তিনি সুর যোগ করেছেন বলে এগুলি সাহিত্য নয় - তা তো বলা যায় না। তাই আমার কাছে কবীর সুমন একজন প্রথম সারির কবি। সাহিত্যকার।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক পরিসরে মাত্র গত কয়েক বছরে আত্মপ্রকাশ করে থাকলেও,  বাঙালি হিসেবে সচেতন হবার কথা নব্বইয়ের দশকেই বলেছিলেন কবীর সুমন। সেই অর্থে বলা চলে স্বাধীনতা-উত্তর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তার তিনি একজন পথিকৃৎ।

হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তাকে প্রথমবার সুমন তুলে ধরেন 1999 সালে প্রকাশিত তাঁর 'পাগলা সানাই' অ্যালবামের "এটাই এখন কাজ" গানটিতে:

"বাংলা ভাষাকে বলছে আঞ্চলিক
হিন্দি রাষ্ট্র মতবাদ গড়ে তুলে,
দরকার হলে আমি খুব প্রাদেশিক
রাষ্ট্র মানি না নিজের ভাষাকে ভুলে,
প্রতিটি ভাষাই জাতীয় ভাষার দাবি
কেউ কারো চেয়ে কম নয় বেশি নয়,
তবুও আমার স্বপ্ন লোকের চাবি
বাংলায় পাই পৃথিবীর পরিচয়।"

যেকোনো সচেতন বাঙালির রক্তে আগুন লাগিয়ে দেওয়া  এই গানে উত্তর প্রজন্মের প্রতি কবীর সুমনের স্পষ্ট আহ্বান:

"প্রতিরোধ করো নজরুল শতবর্ষে
প্রতিরোধ করো একুশে ফেব্রুয়ারি
ভাষার পীড়ন ঘোচাও ভারতবর্ষে
ঘোচাও হিন্দি চাপানোর গাজোয়ারি।"

কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না - কবীর সুমন বাঙালির ঐক্যবদ্ধ হবার ডাক এই গানেই প্রথম দেননি। সুমনের নব্বইয়ের দশকের গানের ভান্ডারের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে বাঙালি হিসেবে তাঁর সুগভীর চেতনা। সরাসরি বাঙালিকে নিয়ে, কলকাতাকে নিয়ে নিজের আবেগের কথা তিনি বারবার বলেছেন বিভিন্ন গানে। কিন্তু এছাড়াও, যে গানগুলি আপাতদৃষ্টিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত নয়, সেগুলোতেও তাঁর এই আবেগ ও চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন একটি কালজয়ী গান, "নবাব নবাবী করে", যা সুমন অনুরাগীরা সকলেই শুনেছেন। এই গানে ফিরে ফিরে আসে বাঙালি হৃদয়ের মূল চাওয়া - "মানুষ ভরসা খোঁজে দিনে আর রাতে - ছেলে মেয়ে গুলো যেন থাকে দুধে ভাতে।" ব্যক্তিগত স্বার্থকে বলিদান দিয়ে সন্তানের জন্য, পরিবারের জন্য বেঁচে থাকা, বাঙালি মূল্যবোধের একটি অংশ। এটি আমাদের বাঙ্গালী সত্তার এতটাই মৌলিক একটি অংশ যে এটিকে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় এমনকি সুদূর অতীতে, 1752 সালে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচিত অন্নদামঙ্গল কাব্যে, যেখানে প্রধান চরিত্র ঈশ্বরী পাটনী ছদ্দবেশী দেবী অন্নপূর্ণার কাছে প্রার্থনা করছেন, "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।"
বাঙালির জন্য, তিলোত্তমা কোলকাতার জন্য সংগীতাচর্যের আবেগ ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর বিভিন্ন গানে, তাঁর 90 এর দশক এবং তৎপরবর্তী সংগীত জীবন জুড়ে। কলকাতা কে নিয়ে একাধিক গান লিখেছেন কবি, যেখানে কলকাতার এমনকি নামোল্লেখ পর্যন্ত নেই - এখানেই তাঁর মুনশিয়ানা। কলকাতা কে নিয়ে লেখা সর্বকালের সব থেকে উল্লেখযোগ্য গান গুলির মধ্যে একটি বোধহয় কবীর সুমনের "তোমাকে দেখছি", যেখানে তিনি তুলে ধরেছেন উচ্চ-নীচ, শহর-গ্রাম, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে বাঙালির অন্তরের ঐক্যের কথা,

"তোমাকে দেখছি বইমেলা চত্বরে
তোমাকে দেখছি স্বতন্ত্র-র স্টল
অনুষ্টুপ এর ঠেলাঠেলি ভেদ করে
আসলে কিন্তু তোমাকে দেখার ছল।
তোমাকে দেখছি বালি উত্তরপাড়া
তোমাকে দেখছি ব্যারাকপুরের মোড়ে
শহরে আসছে ঐতো সোনারপুর
আসলে কিন্তু তোমার ট্রেনে- ই চড়ে...।"

'তোমাকে দেখছি' আসলে এখানে কলকাতাকে দেখা। এই লাইনগুলোর মাধ্যমে সুমন বুঝিয়ে দিয়েছেন এটাই কলকাতা, যেখানে উচ্চ-নীচ, বুদ্ধিজীবী-প্লেব (pleb), ছিপছিপে কবিতা আর দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামের গদ্যের যুক্তি - সবকিছু মিলে মিশে একাকার। সবকিছু শেষ পর্যন্ত বাংলার। সবাই শেষ পর্যন্ত বাঙালি। সুমনের এই ধরনের লাইনগুলি শুনলে আমি অনুভব করি যে প্রতি মুহূর্তেই আমি বাঙালি। আপনি-আমি প্রত্যেকেই। আমাদের তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রতিদিনের কাজ থেকে বৈপ্লবিক বিমুর্ত চিন্তা - সবকিছুই বাঙালিত্বে প্রোথিত, আমাদের জ্ঞানতঃ অথবা অজ্ঞানত।

সবশেষে বলি - কবীর সুমনের বাঙালিত্বের চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর প্রথম সংগীতাক্ষরটি থেকেই। ফিরে যাই তাঁর সর্বকালের সর্বোচ্চ জনপ্রিয় গান, 1992 সালে প্রকাশিত "তোমাকে চাই"তে।

"স্টেশন টার্মিনাস ঘাটে বন্দরে
অচেনা ড্রয়িংরুমে চেনা অন্দরে
বালিশ তোশক কাঁথা পুরোনো চাদরে
ঠান্ডা শীতের রাতে লেপের আদরে
কড়িকাঠে চৌকাঠে মাদুরে পাপোশে
হাসি রাগ অভিমান ঝগড়া আপোসে
তোমাকে চাই...।"

বলুনতো - আদ্যোপান্ত এক বাঙ্গালী যাপন ছাড়া কোন বাস্তবে কি ওপরের লাইনগুলোর কোন মানে দাঁড়ায়? সুমনের সংগীতযাত্রা তাই কোন বিশ্বজনীনতায় আধারিত নয়। আধারিত এই বাংলার মাটিতে ("ভরসা থাকুক মালদা ঝালদা শেয়ালদা আর বর্ধমানে/ভরসা থাকুক জংশনে আর গাঁয়ের ছোট্ট ইষ্টিশনে/ভরসা থাকুক লোকাল ট্রেনে মশলা মুড়ি গরম চায়ে/ভরসা নাচুক বাউল সেজে রেলের দোলায় ঘুঙুর পায়ে")। আধারিত এই মাটির প্রতিটি ধুলি কণায়, বাঙালির হৃদয়ের আবেগে, বাঙালি মূল্যবোধে, বাঙালি বিশ্বাসে, বাঙালি জাতিসত্তায়।

বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলায় যথেষ্ট কর্মসংস্থানের অভাবে বাংলার মেধা চলে যাচ্ছে বাংলার বাইরে। সুমন নিজেও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। 1989 সালে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ফেরার আগে, কর্মসূত্রে প্রায় দেড় দশক তিনি কাটিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে। তাই হয়তো তাঁর 1992 সালের অ্যালবাম তোমাকে চাই এর শেষ গান, তিলোত্তমা কোলকাতা কে নিয়ে লেখা "গড়িয়াহাটার মোড়" এ প্রতিধ্বনিত হয় তাঁর এই ঘরে ফেরার আবেগ:

"আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর
তোমাকে শুনিয়ে আমি যাব বহু দূর।
ফিরেও আসবো আমি তোমার সুবাসে,
থাকবো তোমার বুকে আর আসে পাশে।
আমাকে পড়লে মনে খুঁজো এইখানে,
এখানে খুঁজছি আমি জীবনের মানে।"

আমরা যারা দীর্ঘদিন বাংলার বাইরে কাটিয়েছি,কাটাতে গিয়ে বাংলাকে, বাঙালিত্বকে আরো বেশি করে অনুভব করেছি, তাদের কাছে এই লাইনগুলি অমর। আমরা প্রত্যেকেই চাই, বাংলা যেন একদিন সফল বাঙালির ঠিকানা হয়ে ওঠে। পাকাপাকি ভাবে যেন ঘরে ফিরতে পারে প্রতিটি বাঙালি। নিজের মাটিতে খুঁজে পেতে পারে জীবনের মানে।

আজ সংগীত আচার্যের জন্মদিন। এই লেখার ছোট পরিসরে উল্লেখ করা বাকি থেকে গেল শত শত গানের। শতশত অমূল্য অক্ষরের। কবির ভাষায় বলি, "জানিনা কিছুই। জানি শুধু এই জীবনে বেশি শোনা হবেনা। কিছু আফসোস হয়, তবু জীবন ভরে আমি শুনবো তোমায়।"

জীবন ভরে কবীর সুমনকে তো শুনতেই হবে। কবীর সুমন আমার কাছে বাঙালিত্বের প্রথম পাঠ। তাঁর প্রায় প্রতিটি অক্ষর আমাকে বাঙালির ইতিহাস নিয়ে আরো জানতে, বাঙালি মনীষীদের আরো বুঝতে, বাঙালির অধিকারের লড়াইতে আরো বেশি করে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। প্রতিনিয়ত আমার কানে বাজে বাঙালি ঐক্যের জন্য কবির ডাক - "আমরাই কলকাতা আজ আগামীর....সমুদ্রে ঢেউ ভাঙে আমাদেরই নামে, শ্রমিকের দেহ ভেজে আমাদেরই ঘামে, যে যেখানে লড়ে যায় আমাদেরই লড়া...।"

শেষ লাইনটি একজন বাঙালি জাতীয়তাবাদী হিসেবে আজীবন আমাকে অনুপ্রেরণা যোগাবে। যে বাঙ্গালী যেখানেই অপমানিত, বঞ্চিত - সেটা আমারই অপমান। আমারই বঞ্চনা। যে বাঙালি ভাই বা বোন যেখানেই, যতোটুকু পরিসরেই, হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠুন না কেন, সেটা আমারই লড়াই। আপনারও লড়াই। আমাদের প্রত্যেকের লড়াই। এ কথা আমাদের মনে রাখতেই হবে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে বাঙালির। তাই আবারও সংগীত আচার্যের ভাষা ধার করে বলি,

"সতর্ক হও সময় দামাল বড়
সময়টাকে পাল্টানো চাই আজ
পড় সমকাল, দেয়াল লিখন পড়
প্রতিরোধ করো এটাই এখন কাজ।"

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours