কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিষ্ট, কলকাতাঃ
                 
রোদ্দুর, আপনি ঠিক বলেছেন।
এ আপনার পাপ না। পাপ আমাদের। বাঙালির। তিকড়ম খেলা দেখানো শুরু করেছে ধামাচাপা পড়া বাঙালির সংস্কৃতিবান জিনের ধারক বাহকরা। বেরিয়ে পড়ছে আসল রূপ। রূপটান দিয়ে আর ঢেকে রাখা গেলো না। বসন্তের গন্ধ পেয়েই লাফিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে এলো।
"___ চাঁদ উঠেছিলো গগনে।"

কে বলে বাংলায় এখন শুধুই মধ্যমেধার রবিচাষ?
উদ্ভাবনী শক্তি চাই। মৌলিকতা। তাহলেই বাজিমাত। কে বলে অধুনা বংপ্রজন্ম বাংলা সঙ্গীত বিমুখ? কলি কবিগুরুর। তার থেকে কয়েকটি শব্দ প্লাস মাইনাস। ব্যাস এক ঐতিহাসিক সৃষ্টি। নেচে উঠলো বাংলার এ নব যৌবনের দূতেরা। এলেম আছে বটে রোদ্দুরের।
যাঁরা রোদ্দুরকে শিষ্টভাষায়, গোলগোল শব্দে সমানে তুলোধনা করে চলেছেন, সেই মাননীয়রা বলুন তো, রোদ্দুর কি কারোও ঘাড় ধরে তাঁর 'নব্য রবীন্দ্রসঙ্গীত' গাইতে বাধ্য করেছেন? করেননি। চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের নামটা মনে আছে? 'চাঁদ উঠেছিল গগনে' গানটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রয়াত ওই শিল্পীর নাম। ইউ টিউব খুলে দেখুন, চিন্ময়ের গলায় ওই গানটা শুনেছিল মাত্র উনচল্লিশ হাজার চারশো আটচল্লিশজন। কিন্তু ওই গানে রোদ্দুর কলম চালাতেই, শ্রোতার সংখ্যা একলাফে বেড়ে দাঁড়ালো তিন লক্ষ ন'হাজার তিনশো দশ(দুটি পরিসংখ্যানই এই লেখার সময় পর্যন্ত)।

এর আগে এমন তুফানি উদ্যমে বংসন্তানেরা কখনও কি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন?
না। কভভি নেহি। কিন্তু কপাল মন্দ হলে যা হয়, রোদ্দুরের রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে ফেঁসে গেল, রবীন্দ্র ভারতীর বসন্ত উৎসবের পাঁচ বেচারা। বড়দের দেখে একটু মজা করতে চেয়েছিল মালদার চার কিশোরী স্কুলছাত্রী। সমাজের জাঁতাকলে পেষাই হয়ে গেলো তারাও।
'চাঁদ উঠেছিলো গগনে'র এই নব্য রোদ্দুর ভার্সান মোটেই নতুন নয়। বেশ কিছুদিন ধরেই তা সাইবার দুনিয়ার ভাইরাল। রসিয়ে রসিয়ে তা শুনেছে সঙ্গীত শিল্পপ্রেমী বঙ্গজন। কিন্তু যেই না সেই ভার্সান শোনা গেল রবীন্দ্র ভারতীর আঙিনায়, অনেকেই ফুঁসে উঠলেন। উপাচার্যের ইস্তফা, সিঁথি থানায় অভিযোগ। খবরের শিরোনাম। প্রতিবাদের ঝড়। অমনি নিরাপদ অবস্থান নিলেন ভদ্রজনেরা। চাইলেন কাজির বিচার। এসব হচ্ছেটা কী?

মেধাবী রোদ্দুর। জাতে মাতাল তালে ঠিক। তিনিও ফের আরেক দফা খিস্তি ঝাড়লেন।
"সারাক্ষণ ছেলেপেলেগুলার __ কাঠি করে লাভ নেই।" সাফ বলে দিয়েছেন রোদ্দুর। "এরা ড্রাগ খাবে। খিস্তিখেউড় দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে। তোমায় সব শুনতে হবে," বলেছেন রোদ্দুর। কেন? "কারণ তুমিই এই সংস্কৃতিটা ইমপ্লিমেন্ট করেছ এখানে। অল্টারনেটিভ কিছু দিতে পারোনি।"
বেশ প্রতিবাদীর অম্লঢেঁকুর তুলে বলেছেন রোদ্দুর। নিপুন পায়ে বল ঠেলে দিয়েছেন জনগণের কোর্টে। দায়- দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলেছেন নিজের কাঁধ থেকে। তারপরেই মুচকি হাসি সহযোগে মনেমনে হয়তো বলেছেন, "খেল শালা, এবার কতো খেলতে পারিস কাকা, দেখি।"

খুব একটা মন্দকিছু বলেনি রোদ্দুর।
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে তো কম উঁকিঝুঁকি মারেনি বাঙালি। কোথায় ছিলো তখন সৌজন্যবোধ? প্রশ্ন তুলেছেন রোদ্দুর। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে ঠিক কতটা মাখামাখি হয়েছিল কবির? মৈত্রেয়ীদেবী নাকি লেডি রানু, কাঁর সঙ্গে কবির বেশি মাখামাখি ছিলো? রোদ্দুর না, রবীন্দ্রনাথের পরকীয়া বারেবারে জানতে চেয়েছে বাঙালি। কবির যৌনজীবন নিয়ে বড্ড কৌতুহল।

একদিকে কবিগুরুর পরকীয়া নিয়েও সমানে উসখুস, আবার পান থেকে চুন খসলেই হলো! এই তো রবীন্দ্রনাথকে হেয় করা হয়েছে। একে অপমান করা হয়েছে। ওই তাকে সৌজন্য দেখানো হয়নি। আর কবিগুরুর তোল্লাই আলাদা। শিল্পী রবীন্দ্রনাথের দাঁড়িটা ভুল করে একটু ছোট করে এঁকে ফেললেও,  বাঙালির জাত যায়। বাঙালির রবীন্দ্রপ্রীতির ঠিক এ জায়গাটাতেও, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বিশেষণে এক রামচিমটি কেটেছেন রোদ্দুর।
আমি বলি কী, "বেশ করেছেন ব্রো!"

আর রবীন্দ্রনাথের রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে তো আগেও কিছু কম কাটাছেঁড়া হয়নি। মনে আছে দেবব্রত বিশ্বাসের ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত? বিশ্বভারতীর দাদাগিরি। এই তো কিছুদিন আগেই নচিকেতা পাগলা হাওয়ায় জুড়ে দিয়েছিলেন হু লাল লা। ততদিনে অবশ্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের লাগাম ছিটকে গেছিল বিশ্বভারতীর হাত থেকে। শেষ হয়ে গেছিলো ঠোঁট চেপে, নাসিকাসুরে মেপেমুপে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার দিন।
আবার 'রঞ্জনা আমি আর আসবো না' সিনেমায় কবীর সুমন, সোমলতা, অঞ্জন দত্তর গাওয়া 'জাগরণে যায় বিভাবরী'। রবীন্দ্রসুরে কথা বসিয়ে তৈরি হয়েছিলো 'আমরা চৌধুরীবাড়ির ভূত'। বা তারও আগে, কিশোর কুমারকে দিয়ে 'চারুলতা'য় সত্যজিত রায়ের "আমি চিনি গো চিনি তোমারে" গাওয়ানো। এঁরা প্রত্যেকেই আন্তরিক চেষ্টা চালিয়েছিলেন, ঠাকুরবাড়ির আভিজাত্যের মোড়ক থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে বের করে আনার।
এই যাবতীয় মাস্টার স্ট্রোকগুলোই আপনি একলাফে ডিঙিয়ে গেলেন রোদ্দুর। ব্র্যাভো!
আর লাফাবেনই বা না কেন, আধুনিক প্রজন্মের বংসন্তানদের মনের অন্তরালের তারটিতে টুং টাং বাজিয়েছিল আপনার ওই বিশেষ শব্দরা। বসন্তের সুরসুরি। শাড়িজড়ানো সাজগোজ করা গোলগাল বেলুনে আলপিনের এক খোঁচা। ভুস করেই বেলুনের নেতিয়ে পরা নিজের শ্রীরূপ। তাই আপনাকে শুধু ওয়াক ওভার না, একটা ঘাড়ধাক্কাও দেওয়া যেতেই পারে। আপনার কেরামতিতেই খসে পড়লো কত অজস্র মুখোশ।
আপনি আবার ধাক্কা মারলেন সেই বাঙালি অচলায়তনে। যেখানে একসময়ে ধাক্কা মেরেছিলেন কবি বিষ্ণু দে। "তুমি কি শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ?" ঠিকই বলেছেন রোদ্দুর, সেই থেকে বটবৃক্ষ বটব্যালরা ভারী গলায় আফ্রিকা আবৃত্তি করে চলেছেন। ওদিকে তখন ক্রমেই অধঃপাতে তলাচ্ছে বংসংস্কৃতি। ভিয়েতনামে বৃষ্টি আর আলিমুদ্দিনের মাথায় ছাতা। শহরের রাজপথে জোর শ্লোগান- তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম।
"প্রতিবাদের নতুন ভাষাই বোঝে না কলকাতা," বলেছেন খিস্তিস্কলার রোদ্দুর। এক ছাত্রের ব্রা প্যান্টি পরে যাদবপুরী আন্দোলনে ওই 'নয়াভাষা' দেখেছিলেন রোদ্দুর। তাঁর পরিভাষায়, শিরদাঁড়াহীন মধ্যবিত্ত বাঙালি। মদ মাংস কালচার। মান্ধাতা শিক্ষাব্যবস্থা। বাবার গ্যাঁটের জোর থাকলে তৈরি হচ্ছে মেরুদন্ডহীন কিছু শিক্ষিত। প্রভাবশালীদের ধরেপরে কেরিয়ার তৈরি। বগলদাবা সুন্দরী বউ। ব্যাস, সফল জীবনাবৃত্ত শেষ।

বাঙালি ঐতিহ্যের কোন কথাটাই বা বলবেন?
মহর্ষির শান্তিনিকেতনকে ঠাকুরদের বেলেল্লাপনা করার জায়গা বলেছিলেন, তৎকালীন আরেক নামজাদা বঙ্গকবি আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোরা। এমনটাই শোনা যায়। রবীন্দ্রনাথের কাছায় টান মারলেই যে নিমেষে প্রচারের আলোয় চলে আসা যায়, তা সেই আদিকাল থেকেই অনেকে বুঝে ফেলেছিলেন।
এই ধরুন কিছুদিন আগের এক বই। রসের কালিতে কলম ডুবিয়ে, লেখক ফাঁস করতে চাইলেন কাদম্বরীদেবী রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক। পাঠকের হাতে তুলে দিলেন রবির বৌঠাকুরানীর লিখে রেখে যাওয়া সুইসাইড নোট। কিন্তু সেই নোট ওই লেখকার হাতে তুলে দিলো কে? এতদিন তো জানতাম, কাদম্বরীদেবীর শ্মশানযাত্রার সঙ্গে- সঙ্গেই ঠাকুরবাড়ি থেকে তাঁর যাবতীয় স্মৃতি মুছে ফেলেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সেই বাঙালি 'ভদ্রজনের' জিনেই লুকিয়ে রোদ্দুরেরও জন্মরহস্য। পূঁজি বলতে মাত্র কয়েকখানা মামুলি খিস্তি। ব্যাস তাই বসিয়ে দিলেন কবিগুরুর কলিতে। বাদবাকী কাজটুকু করে দিলো সংস্কৃতিবান মুক্তমনা উঠতিরা।

পাগল ছাগল মানুষ রোদ্দুর।
একেবারেই ভুল ধারনা। রাজনীতির অলিগলিতেও দিব্য নজরদারি আছে তাঁর। দলবাজি হয়ত করেন না। কারণ দলগুলিকেও খিস্তিখাস্তা করতে ছাড়েননি তিনি। ওদিকে আবার স্বপ্ন দেখেন এক অবিভক্ত বাংলার। তাঁর সেই স্বপ্ন নিয়ে লিখে ফেলেছেন আস্ত একটা বই। সম্ভবত জানুয়ারি মাসেই সেই বইয়ের প্রকাশ করলেন তিনি কলকাতাতে। শোনা যায়, ওই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন সিপিএমের তরুন তুর্কী শতরূপ ঘোষ, বাংলাপক্ষের কর্তা গর্গ চট্টোপাধ্যায়। ছিলেন এমনকিছু উঠতি যাঁরা স্বঘোষিত বাংলাভাষা বাঙালি সংস্কৃতির অভিভাবক হয়ে উঠতে চাইছেন।

সোজা কথায়, বাজারগরম করা এই মানুষটি ভেক ধরলে তাঁর নাম রোদ্দুর রায়। অন্য সময়ে তিনি অনির্বাণ। এই অনির্বাণ বেশ চালাক চতুর, ধুরন্ধর। তিনি বিরক্ত আজকের রাজনীতিতে। মধ্যবিত্তের সবজানাতে। ঘুনধরা সাংস্কৃতিক চর্চাতে। এলিট, অভিজাত বাঙালি সাহেব-মেমদের ডেঁপোমিতে। ঘুনধরা সাংস্কৃতিক চর্চা, ভন্ডামির আবেগে।
গা চিড়বিড় করে ওঠে অনির্বাণের। তখনই সে ওই স্পাইডার ম্যান বা শক্তিম্যান হয়ে ওঠে। নাম হয় রোদ্দুর। তারপরেই কেটে যায় মুখের জড়তা। হিলহিল করে বেরিয়ে আসে চেড়া জিভ। বিষ ওগড়ায়। বিষের নেশায় শরীর দুলে ওঠে আধুনিক, শিক্ষিত নব্য বংসন্তানের। তলপেটে ঝড়। আগামীর এলিট। খসে পড়ে কাপড়-চোপড়। উদোম বংসন্তান। কোরাস গায়- শালা চাঁদ উঠেছিলো গগনে।

বাংলা বাঙালির অভিভাবকদের, কারুর মুখে কুলুপ। কেউ দেখতে পেলেও শুনতে পাননি। আবার অনেকে শুনতে পেলেও দেখতে পায়নি ওরা কারা। গাঁধিজির তিন বাঁদরের দশা। কেউ বললেন রবীন্দ্র ভারতীর। ফোঁস করে উঠলেন অন্যেরা- কভভি নেহি। সব অরবীন্দ্র ভারতীর। কেউ পাশে দাঁড়ালো। কেউ তেড়ে গেলো। ব্যাস ওই পর্যন্তই।

এই আধমরাদের ঘা মেরেই রোদ্দুর দেখিয়ে দিলো আমাদের বর্তমান কী। আর ভবিষ্যতটাই বা কী।
আর ওই বিকৃত রবীন্দ্রগান তো অজুহাত।
রোদ্দুর নিমিত্তমাত্র।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours