সন্দীপ চক্রবর্তী, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা:

এমএ পাশ করার পর মেধাবী ছাত্রটি কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গের কলেজে বিএ পরীক্ষায় ফেল করল! কথাটা যতই আজগুবি শোনাক, সংসদের দুই কক্ষে ছাড়পত্র পাবার পর ওই দুটি রাজ্যের বিধানসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন-বিরোধী প্রস্তাব পাশের ঘটনাটি সেরকমই। ভারতের সংবিধান বলছে, সংসদের উভয় কক্ষে কোনও বিল পাশ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি তাতে স্বাক্ষর করা মাত্র বিলটি আইনে পরিণত হয়। এরপর কেন্দ্র ওই আইন সরকারি গেজেটে নোটিফিকেশন-সহ প্রকাশ করবে। যেদিন গেজেট প্রকাশিত হবে সেদিন থেকেই দেশের প্রতিটি রাজ্যে আইনটি লাগু হবে। কোনও রাজ্য সরকারের এ বিষয়ে আপত্তি থাকলে তারা আদালতে যেতে পারে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাজ্যটিতে আইন লাগু করা থেকে তারা বিরত থাকতে পারবে না। আদালত যদি আইনটির বিরুদ্ধে রায় দেয় এবং স্থগিতাদেশ জারি করে একমাত্র তখনই আইনটির প্রয়োগ বন্ধ করা যেতে পারে।
 অর্থাৎ সংবিধান বলছে মর্যাদা, ক্ষমতা এবং গুরুত্বের বিচারে দেশের সংসদ কোনও রাজ্যের বিধানসভার থেকে অনেকটা ওপরে। গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে কোনও রাজ্য সরকার সংসদ-প্রণীত আইনকে উপেক্ষা করতে পারে না। কিন্তু সংবিধান যাই বলুক বাস্তবে আমরা এর উলটো ছবিটাই দেখতে পাচ্ছি। ইতিমধ্যেই কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। কেরলের বামফ্রন্ট সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের বক্তব্য মোটামুটি একই। আইনটি অসাংবিধানিক এবং ধর্ম ও জাতপাতের ভিত্তিতে মানুষে-মানুষে বৈষম্য সৃষ্টিকারী। এই আইন প্রণয়ন করে কেন্দ্র সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ ধারা লঙ্ঘন করেছে। সুতরাং কেরলের বামফ্রন্ট সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার সংশ্লিষ্ট দুটি রাজ্যে আইনটি লাগু করবে না।
 এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ নম্বর ধারায় কী বলা হয়েছে। ১৪ নম্বর ধারা বলছে, ভারত এবং ভারতের আইনের দৃষ্টিতে প্রতিটি নাগরিক সমান মর্যাদাসম্পন্ন। প্রতিটি নাগরিককে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়ে ভারত বদ্ধপরিকর। ১৫ নম্বর ধারা বলছে, ১) ভারত কখনোই তার নাগরিকদের সঙ্গে ধর্ম, জাতপাত, বর্ণ, লিঙ্গ, জন্মস্থান ইত্যাদির ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না, ২) কোনও নাগরিক তার ধর্ম, জাতপাত, বর্ণ, লিঙ্গ এবং জন্মস্থানের কারণে কোনও সরকারি নিষেধাজ্ঞা বা শর্তের মুখোমুখি হবেন না। যেমন—ক) তারা দেশের যে কোনও প্রান্তে রুটিরুজির জন্য দোকান খুলতে পারবেন। যে কোনও পাবলিক রেস্তোরা, হোটেল এবং সিনেমা/থিয়েটার হলে যেতে পারবেন। খ) সরকারি অর্থে নির্মিত যে কোনও কুয়ো, জলের ট্যাঙ্ক, স্নানের ঘাট ব্যবহার করতে পারবেন। ৩) এই ধারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে হলেও, নারী ও শিশুদের জন্য সরকার যদি কোনও বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার বিরুদ্ধে নয়, এবং ৪) সামাজিক এবং শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়া নাগরিকদের জন্যে যদি বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এই ধারা তাকেও সমর্থন করে।
 এবার দেখা যাক নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটি কী বলছে। আইনে কী আছে জানার আগে দুটি সংজ্ঞা আমাদের ঠিক করে নিতে হবে। শরণার্থী কারা আর অবৈধ অনুপ্রবেশকারী কারা। রাষ্ট্রসংঘের বিধিবদ্ধ সংজ্ঞা অনুযায়ী, যখন কোনও ব্যক্তি ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত বা বিশেষ কোনও রাজনৈতিক ভাবধারার অনুগামী হওয়ার জন্য নিজের দেশে অত্যাচারিত হয়ে অন্য কোনও দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন তখন দ্বিতীয় দেশটিতে তিনি শরণার্থী হিসেবে গণ্য হবেন। অন্যদিকে যারা রুটিরুজির কারণে বা ওপরে বর্ণিত কারণগুলি ছাড়া অন্য কোনও কারণে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যান তারা দ্বিতীয় দেশটিতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বলছে, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে ওইসব দেশে সংখ্যালঘু যেসব হিন্দু, বৌদ্ধ, পার্সি, জৈন, শিখ এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ নিজের দেশে ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত কিংবা কোনও বিশেষ রাজনৈতিক মতামত পোষণ করার কারণে অত্যাচারিত হয়ে এ দেশে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-এর আগে এসেছেন, ভারত তাদের বিনা শর্তে কোনওরকম কাগজপত্র ছাড়াই নাগরিকত্ব দেবে। একটি বিশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে এই ধারাটি যোগ করা হয়েছে। এই আইনে কোথাও ধর্মমত নির্বিশেষে কোনও বৈধ ভারতীয় নাগরিকের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার কথা বলা হয়নি। এই আইন শুধুমাত্র শরণার্থীদের জন্য। এর মাধ্যমে ভারতের নাগরিকদের সঙ্গে ধর্ম, জাতপাত, বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিধানসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ করতে গিয়ে সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ ধারা লঙ্ঘনের যে অভিযোগ করেছে তা সর্বৈব মিথ্যা। এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
 নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন গৃহীত হবার পর থেকে একাধিক বিশেষজ্ঞ আইনটির সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে তাদের নিজস্ব মতামত দিয়েছেন। বিখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাস কাশ্যপ এই আইনের মধ্যে অসাংবিধানিক কিছু পাননি। সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করার অভিযোগও তিনি মানেননি। স্পষ্ট বলেছেন, সরকার সব দিক খতিয়ে দেখে সংবিধান মেনেই আইনটি প্রণয়ন করেছে। তবুও আইনের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে ১৫০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যারা মামলা করেছে তাদের মধ্যে কেরল সরকার আছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার মামলা না করলেও তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র একটি মামলা দায়ের করেছেন। এইসব মামলার শুনানিই এখনও শুরু হয়নি। অর্থাৎ আইনটি সংবিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ না অবৈধ সে ব্যাপারে আদালত রায় দেবার আগেই কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় আইনটির বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ হয়েছে। এখানে প্রশ্ন উঠবে, আদালতের রায়দান পর্যন্ত কি অপেক্ষা করা যেত না? বিশেষ করে কেরল সরকার নিজেই যেখানে অন্যতম এক মামলাকারী। আদালতের রায় যদি গুরুত্বপূর্ণ নাই হয় তা হলে মামলা করার দরকার কী?
 এসব প্রশ্নের উত্তরে একটা কথাই বলতে হয়, সব কিছুর পিছনে রয়েছে ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি। ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে পরিকল্পনাটি সাজানো হয়েছে নিপুণভাবে। আইন গৃহীত হবার পরেই শুরু হল সারা দেশজুড়ে ভয়াবহ দাঙ্গাহাঙ্গামা। ট্রেনবাস পুড়ল, রেললাইন উপড়ে ফেলা হল। সারা দেশে কয়েকশো কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করল একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের জিহাদিরা। দ্বিতীয় পর্যায়ে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় এবং জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অশান্তি শুরু হল। মিডিয়া প্রচার করল সারা দেশের ছাত্র সমাজ জেগে উঠেছে। মোদীর আর রক্ষে নেই! তৃতীয় পর্যায়ে আমরা দেখলাম দিল্লির শাহিনবাগে বোরখা পরা মুসলমান মহিলারা ধর্নায় বসলেন। মিডিয়া বলল, শুধু ছাত্ররা নয় ভারতের মহিলারাও এবার জেগে উঠেছেন। এসবের উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, আদালতকে প্রভাবিত করা। যাতে আদালত প্রথম চোটেই আইনটির ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে। যাতে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হতে বসা বিজেপি-বিরোধী বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি তাদের মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক গুছিয়ে নেবার সুযোগ পায়। এবং যাতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে শরণার্থীদের তালিকায় মুসলমানদের ঢোকানো যায়। কিন্তু আদালত প্রভাবিত হল না। স্থগিতাদেশ জারি করা হল না। মামলগুলি চলে গেল পাচ বিচারকের সাংবিধানিক বেঞ্চে। মুখ পুড়ল বিরোধীদের। সামনেই দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন। এক বছর পর পশ্চিমবঙ্গে। তাই ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামল কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বিধানসভায় পেশ করা হল বিরুদ্ধ প্রস্তাব। পাশও হয়ে গেল।
  ভারতবর্ষ থেকে হিন্দুত্ব নামক বটগাছটিকে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলতে গিয়ে এ দেশের বিরোধী রাজনীতিকেরা যে ডালে বসে আছেন সেটিকেই কাটতে শুরু করেছেন। তারা জানেন দেশের মুসলমানদের একাংশ স্রেফ নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে আরেকবার দেশভাগ করতে চায়। ঠিক যেমনটি তারা ১৯৪৭ সালে করেছিল। তবুও এইসব রাজনীতিক এবং মিডিয়া তাদের আজাদির আবেগে সুড়সুড়ি দিচ্ছেন। ভাবছেন মোদীকে সরাতে পারলেই কেল্লা ফতে! কিন্তু তারপর কী হবে ভাবছেন না। বাঘের পিঠে একবার চাপলে আর নামা যায় না। বাঘ একটু একটু করে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যায়।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours