শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

এক সময় ভারতবর্ষে ইংরেজি ভাষাকে মুসলমানদের জন্য হারাম ঘোষনা করেছিলেন, এ উপমহাদেশের আলেম সমাজ। মুসলিমরা সত্যি সত্যিই  ইংরেজি শিখেনি। যার কারনে মুসলিম সম্প্রদায় পিছিয়ে পরে। কয়েকজন মুসলিম স্কলার অনেক চরাই উৎরাই পেরিয়ে মুসলিমদের আবার শিক্ষা ও ইংরেজিমুখি করেন।
আমি যে কোন ঘটনায় ইতিহাস খুঁজে দেখি। ভুল থেকে কেউ শিক্ষা নেয় কি না। সাধারনত ফ্যাসিষ্ট শাসকেরা নেয় না। তেমনি ১৯৫২ সালে যখন ঢাকার অধিবাসী ও  ' ভালো মানুষ পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন "বাবা এ কওম' মোহাম্মদ আলীর পথ অনুসরণ করেই বললেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। বাংলার জনগন জিন্নাহ ও লিয়াকত আলীকে  বাংলা রাষ্ট্র ভাষা প্রশ্নে আগেই প্রত্যাখান করেছিলো। এবার আন্দোলন  আরো অগ্নীগর্ভে পরিণত হয়।  বাংলার ছাত্র- জনতার দাবী ঠেকাতে ভাষা আন্দোলনে, ভারতের হিন্দুদের ষড়যন্ত্র রয়ছে  বলে, "মর্নিং নিউজ " পত্রিকায় খবর প্রকাশ করে পাকিস্তান সরকারের মদদে। এ মিথ্যা খবরে ক্ষিপ্ত হয়ে  জনতা পত্রিকা অফিসে হামলা চালায়। সেখানেও পুলিশের গুলিতে, তথা ২২ ফেব্রুয়ারিতে আরো ৫ জন নিহত  ও শতাধিক আহত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারিতে তো ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সালাম বরকত শফিউল জব্বার সহ কয়েকজন নিহত ও আহত  হয়েছিলোই। ১৯৫২ সালের  ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে নিহতদের জানাজা, গায়েবানা জানাজায় সরকার এতই উদ্বিগ্ন হয়ে পরে যে, মুসলিম লীগ কে আলেম উলামা ভাড়া করে ঘোষনা করতে হয় যে, তথা ফতোয়া দেয়া হয়, "বাংলা কাফেরের ভাষা!"

কিন্তু মুসলিম লীগ সরকারের বন্দুকের নল ও ফতোয়া তথা অস্ত্র ও ধর্মাস্ত্র দুটোই পেছনে ফেলে ছাত্র জনতার বাংলা রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন পূর্বপাকিস্তানের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পরে দাবানলের মত। পাকিস্তানের গভর্নর ও "বাবা এ কওম" (জাতির পিতা) মোহাম্মদ আলী  জিন্নাহ ও পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানেরা বুঝতেই পারেন নি। পূর্ববাংলা আসলে,  পাঞ্জাব, সিন্ধ বা বেলুচিস্তান নয়। যে, বন্দুকের নল দেখিয়ে  বাঙালির ঘাড়ে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়া যাবে। পাঞ্জাবী ও মুসলিম লীগ শাসকেরা অনুমানই করতে পারেনি বাঙালিরা,  বৃটিশ ও হিন্দু জমিদারদের খপ্পর থেকে বের হয়ে পাকিস্তানী শাসকদের আবদার মানবে না। শাসকেরা ভেবেছিলো, বাঙালি ধর্মভীরু তাই বাংলাকে আরবী হরফে লেখার প্রচলনের মত  ষড়যন্ত্রও করে। যা,  এ দেশের ছাত্র -শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক সাংবাদিক, লেখক তথা সকল শ্রেনীর মানুষ কতৃক প্রত্যাখাত হয়।

ভারত, ভাগের পর ১৯৪৮ সালে মার্চ মাসে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্দ্যান) এক জনসভায়,  বলেন, "এক মাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।"  বাক্যটি বলেন, ইংরেজিতে। চাইলেন উর্দু কিন্তু বললেন, অন্য ভাষায়;  বিচিত্র বটে! জিন্নাহ তার সফরের তৃতীয় দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবনে এক সুধী সমাবেশ বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জিন্নার রেসকোর্স ময়দানে দেয়া রাষ্ট্র ভাষা সম্পর্কিত বক্তব্যের স্পষ্ট ব্যাখা চায়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ আবারো তার সেই বক্তব্যের অংশই পুনরাবৃত্তি করেন। ছাত্ররা এবার তার সামনেই তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে। জিন্নার পর আবার নানান ভাবে  লিয়াকত আলী খান বৃথা চেষ্টা করেন উর্দুকে বাঙালির উপর চাপিয়ে দেয়ার। ব্যার্থ হন। অতপর ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমউদ্দীনের সকল ষড়যন্ত্র পূর্ববাংলার জনতার কাছে ধরা পরে। এবং আন্দোলন এত তীব্র হয় যে, বাংলার জনগনের নিকট মুসলিম লীগ সরকার মাথা নত করতে বাধ্য হয়। বৃটিশ ভারতের অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী  মৌলনা আবুল কালাম আজদ ভারত দেশ ভাগের আগেই একটি কাশ্মীরী পত্রিকায়  বলেছিলেন; মুসলিম লীগ নেতারা বাঙালির চিন্তা চেতনা বুঝতে পারবে না। এবং পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে।  তার অনুমানই সত্য হয়। পাকিস্তান ভাঙ্গার বীজ বপন হয়, রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
বাংলা রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন আজ বিশ্ব স্বীকৃত। ১৯৫২র ২১শে ফেব্রুয়ারির বুকের তাজা রক্তদান বৃথা যায়নি। কাফেরের ভাষা,  হিন্দুর ভাষা বলে বাংলা ভাষাকে দাবিয়ে রাখা যায়নি।
ছোট বেলায় আমরা  ২১ ফেব্রুয়ারি,  ভাষা  শহীদ  দিবস বলতাম। এখন সেই শহীদ দিসব আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ভাষা শহীদ আবুল বরকতকে পুলিশ যেখানে গুলি করে ছিলো, সেই স্থানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করেছিলো। সেই স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধক ছিলেন,আরেক ভাষা  শহীদ শফীউর রহমানের পিতা।  যা আজ শহীদ মিনার হিসেবে পরিচিত। ১৯৫২ ২১ ফেব্রুয়ারির বাংলা সন ছিলো, ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮। ১৯৫২ র  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সাল থেকে  জাতিসংঘের গৃহীত  সিদ্ধান্ত অনুসারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে  বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours