শিবাশীষ বসু, ফিচার রাইটার, উত্তরপ্রদেশ:

বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের মেলবন্ধন করবার ইচ্ছা রবীন্দ্রনাথের বরাবরই ছিল। সম্ভবত এই প্রয়াসেই বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং প্রশান্তচন্দ্র মহালনবিশ ছিলেন কবির অতি কাছের মানুষ। আর আইনস্টাইনের সঙ্গে কবির কথোপকথনের কাহিনী তো জগতবিখ্যাত হয়ে আছে। এর সবকিছুই তাঁর বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল ভালবাসার প্রমাণ হিসাবে আমরা নিতে পারি। 'ভারতী' 'বালক' ও 'সাধনা' পত্রিকা তিনটিতে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানালোচনায় প্রথম উদ্যোগী হন যাহাতে তিনি বেশ কযেকটি বিজ্ঞানপ্রবন্ধ লিখেছিলেন। তবে তাঁর এই ভালোবাসার চুড়ান্ত প্রকাশ দেখা গেল জীবনের শেষ লগ্নে এসে যখন তাঁর হাত থেকে 'বিশ্বপরিচয়'র মতো অসাধারণ বিজ্ঞান গ্রন্থখানির সৃষ্টি হল। তিনি যে বিজ্ঞানপ্রেমিক ছিলেন, বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে তাঁর যে লোভের অন্ত ছিল না, সেটা আমরা এই বইয়ের উৎসর্গপত্র থেকেও জানতে পারি। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে।

বিশ্বপরিচয় গ্রন্থখানি পড়লে আমাদের মনে হতেই পারে যে রবীন্দ্রনাথ হয়তো বিজ্ঞানের উপরে অগাধ পড়াশোনা করে নিজের জ্ঞান ও উৎকর্ষতা বাড়িয়ে নিয়ে, নিজেকে বিজ্ঞান-সমৃদ্ধ করে গ্রন্থটি লিখতে বসেছিলেন। তাঁর মানের একজন ব্যক্তি, যিনি নিজেকে ক্রমাগত ভেঙেছেন ও গড়েছেন - এ কাজ করতেই পারেন। বিশেষত বিশ্বপরিচয়ের উৎসর্গপত্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উদ্দেশ্যে তিনি যখন বলেন, "আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বালককাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না।" এবং দাবী করেন, "কয়েকটি প্রামাণ্য গ্রন্থ সামনে রেখে সাধ্যমতো নিড়ানি চালিয়েছি।"  তখন এ কথা আমাদের মনে হতেই পারে যে রবীন্দ্রনাথ সত্যিই বোধহয় বিজ্ঞানের বেশ কিছু আকর গ্রন্থ পড়ে বইখানি লিখতে বসেছেন।
কিন্তু ছন্দপতন ঘটে যখন ওই একই উৎসর্গপত্রের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ অন্যরকম কিছু মন্তব্য করে বসেন। যদিও তিনি আন্তরিক অকপটতায় কথাগুলো বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ত‍ার মধ্য থেকেই বেরিয়ে এসেছিল এক সংশয়। প্রথমে দেখা যাক, রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী বলেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "শ্রীমান প্রমথনাথ সেনগুপ্ত, এম. এসসি, তোমারই ভূতপূর্ব ছাত্র। তিনি শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান-অধ্যাপক। বইখানি লেখবার ভার প্রথমে তাঁর উপরেই দিয়েছিলেম। ক্রমশ সরে সরে ভারটা অনেকটা আমার উপরেই এসে পড়ল। তিনি না শুরু করলে আমি সমাধা করতে পারতুম না, তাছাড়া অনভ্যস্ত পথে শেষ পর্যন্ত অব্যবসায়ীর সাহসে কুলোত না। তাঁর কাছ থেকে ভরসাও পেয়েছি, সাহায্যও পেয়েছি।"

সংশয়টা এইখানেই শুরু হয়। জেগে ওঠে অনেক প্রশ্ন। যে বই লেখার ভার পড়েছিল প্রমথনাথের উপরে, হঠাৎ করে সেই ভার রবীন্দ্রনাথের ঘাড়ে গিয়ে পড়লো কেন? প্রমথনাথ ঠিক কতখানি শুরু করেছিলেন? তিনি কেন শেষ করেন নি? যতটুকু শুরু করেছিলেন তাতে করে সহলেখক হিসাবে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়াটা যুক্তিসঙ্গত ছিল কি না? আসুন দেখি, একে একে এই প্রশ্নগুলির জবাব পাওয়ার চেষ্টা করি।

মূল ঘটনায় যাবার আগে ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থটির শুরুর ইতিহাসটুকু একটু জেনে নেয়া যাক। রবীন্দ্রনাথের এক সময় ইচ্ছে হয়েছিল ‘লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা’ রচনা করবার। "সেই গ্রন্থমালার উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষণীয় নানা বিষয়কে বাংলাদে‍শের সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। সুতরাং রচনার ভাষাকে হতে হবে সহজ সরল এবং যথাসম্ভব পরিভাষা বর্জিত। অথচ তার মধ্যে বিষয়বস্তুর দৈন্য থাকবে না।" মহাবিশ্ব সংক্রান্ত এই ‘লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা’ সিরিজের প্রথম বইটি লেখবার ভার তিনি দেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকের কাজ নিয়ে বিশ্বভারতীতে যোগ দেয়া তরুণ অধ্যাপক প্রমথনাথ সেনগুপ্তের উপর।

অভিজিত রায়, রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের 'রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য : প্রবেশক চতুর্থ খণ্ড' বই থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, "কবির ইচ্ছা যে, এই লোকশিক্ষা গ্রন্থমালার প্রথম গ্রন্থ হইবে বিশ্বপরিচয়। কবি বলেন, ‘বুদ্ধিকে মোহমুক্ত ও সতর্ক করবার জন্য প্রধান প্রয়োজন বিজ্ঞানচর্চার। … জ্ঞানের এই পরিবেশনকার্যে পাণ্ডিত্য (pedantry) যথাসাধ্য বর্জনীয় মনে করি।  এই প্রথম গ্রন্থখানি লিখিবার ভার অর্পণ করা হইয়াছিল প্রমথনাথ সেনগুপ্তের উপর। প্রমথনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র, সত্যেন বসুর প্রিয় শিষ্য, শিক্ষাভবনে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক।"

এবার দেখা যাক, ঘটনাপ্রবাহ কিভাবে এগিয়ে চলেছিল।

(চলবে)

তথ্যসূত্র :
বিশ্বপরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ
রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স
রবি ঠাকুর, রাহাজানি এবং রবীন্দ্র পুজারীবৃন্দ, অভিজিত, মুক্তমনা ডট কম

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours