নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া:

বন্ধু তোমার নীল আকাশের নীল নীল বৃষ্টিতে, স্নাত হব ঝিরি ঝিরি উন্মাদ দৃষ্টিতে!
কিংবা
বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম।
কত কত কথাই তো আছে পড়ে ইতিহাসে
গানে কবিতায় গল্পে আর জীবনের জলছবিতে ।
কোথায় যেন পড়েছিলাম -শত্রুকে যদি একবার ভয় কর তবে বন্ধুকে অন্তত দশবার ভয় করিও, কারণ বন্ধু যদি কোনোসময় শত্রু হয় তখন তার কবল হইতে বাঁচা দায়।...বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- বন্ধু শত্রু হতে সময় লাগে না। ... কারণ যাকে আপনি এতটা পছন্দ করেন, যাকে সবচেয়ে কাছের মনে করেন সে আপনার ... তবে অনেক সময় মানুষ যা চিন্তা করে না, সেটাই ঘটে।

বন্ধু শব্দটির সঙ্গে আস্থা, বিশ্বাস ও অকৃত্রিম ভালোবাসা জড়িত। বন্ধু ও বন্ধুত্ব নানাভাবে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। একজন ভালো বন্ধু জীবনকে যেমন সুন্দর করে তুলতে পারে, ঠিক তেমনি একজন খারাপ বন্ধু জীবনে ব্যর্থতার কারণ হতে পারে। তাই বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্কতা খুবই জরুরি। কিছু মানুষ আছে যাদের সাথে বন্ধুত্ব করা উচিত না, কেননা তাদের স্বভাব ও আচরণ জীবনে বিপত্তির কারণ হতে পারে।

কথায় আছে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস আর অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। যদি ভালো বন্ধুর সঙ্গে থাকেন, তবে তার ভালো গুণগুলো আপনার মাঝে সংক্রামিত হবে। ঠিক তেমনি যদি নেতিবাচক মানুষের সাথে সময় কাটান, তার নেতিবাচক মনোভাব আপনার মাঝে দেখা দেবে।
আমাদের নানান ধরণের মানুষের সাথে বন্ধুত্বের তকমা নিয়ে ঘুরতে হয় । সব্বাইকে যেমন চেনার যায় না , সব সময় বুঝে উঠবার সুযোগও হয় না।
তারপরেও আচরণ চলন বলনে কিছুটা আঁচ করা যায় । তবে জাহির করা মানুষ খুব ভয়ঙ্কর হয় যেমন -যারা সবসময় সবকিছুতে নিজেকে জাহির করে থাকে, এমন বন্ধুদের এড়িয়ে চলুন। এই ধরনের মানুষেরা সব সময় নিজেকে বড় ভাবে। নিজের জ্ঞান, নিজের জানাকে বেশি করে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এই ধরণের মানুষেরা স্বার্থপর হয়ে থাকে। বন্ধু সেজে ক্ষতি করাটাও বেশ সোজা। কারণ বন্ধুকে মানুষ অন্ধের মত বিশ্বাস করে। আর এই সরল বিশ্বাসের সুযোগ নেয় বন্ধুরূপী শত্রুরা। তাই বলে কি সব বন্ধুকেই অবিশ্বাস করা যায়? মনে অবিশ্বাস নিয়ে তো আর বন্ধুত্ব করা যায় না। কিন্তু সচেতন থেকে বন্ধুত্ব করা জরুরী বটে। আমরা ইতিহাসের পাতা থেকে অনেক এমন নজির পেতে পারি যেমন -
“সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসি দেবার পর যখন তাঁর মরদেহ বাইরে রাখা হলো তখন একদল মানুষ সেখানে এসে এই মানুষটার মৃতদেহের ওপরে থুতু ছিটিয়ে ছিলো, যারা প্রত্যেকেই ইরাকের নাগরিক; পক্ষান্তরে তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত সেই ১২ জন আমেরিকার সেনা সদস্যের প্রত্যেকেই কেঁদেছিল।
ইন্দিরা গান্ধীর পরিণতি হয়েছিল আরও করুণ। শত্রুর গুলিতে না, তার মৃত্যু হয়েছিল নিজেরই দেহরক্ষীর গুলিতে।
বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের দেহ নামাতে যে লোকটি কবরে নেমেছিল, বঙ্গবন্ধুর মাতার মৃত্যুতে যে লোকটি মাটিতে শুয়ে কান্নায় গড়াগড়ি করে ছিলো, শেখ কামালের বিয়ের উকিল বাপ যে মানুষটি ছিলো, ১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট দুপুরে যে লোকটি বাসা থেকে তরকারী রান্না করে নিয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে খাইয়েছিলো তারপরের দিন ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে খুন করেছিল তার নাম খন্দকার মোশতাক...

ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়, এক একটা সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে তাদের সব চাইতে কাছের মানুষদের হাত ধরে। সৌদি আরবের বাদশা ফয়সাল যখন তার ভাইপোকে আলিঙ্গন করার উদ্দেশ্যে দু হাত বাড়িয়ে দিলেন, প্রতি উত্তরে হঠাৎ পকেট থেকে পিস্তল বের করে পরপর তিনটা গুলি করে বসলেন।

গোয়েন্দারা আসামী সনাক্ত করার জন্য অনেক গুলো পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে, তার একটি হল প্রত্যেককেই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা। সব চাইতে বেশি সন্দেহ তাকে করা যাকে মনে হবে সব চাইতে কম সন্দেহজনক।
ইতিহাস আমাদের বার বার শিখিয়ে গেছে, মানুষের জীবনের সব চাইতে বড় যে শত্রু তাকে কখনোই চেনা যায় না, সে থাকে সব থেকে কাছের বন্ধুর মত করে।

আপনার ব্যক্তিগত জীবনেও তাই...
আপনি সব চাইতে বেশি প্রতারিত হবেন আপনার কাছের মানুষদের কাছ থেকে। আপনাকে সব চাইতে বেশি কষ্ট দেওয়া মানুষের তালিকা করলে সেখানে শত্রু না, বন্ধুদের নাম দেখতে পাবেন। শত্রু কখনো বিশ্বাস ঘাতক হয় না, বিশ্বাসঘাতকতা করে কেবল বন্ধু ও কাছের স্বজনরা।”

প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় মেলে বিপদের সময়। আপনি যখন বিপদে পড়বেন তখন প্রকৃত বন্ধুরাই সবার আগে এগিয়ে আসবে। প্রকৃত বন্ধু আপনার সাথে কখনোই মিথ্যা বলবে না। যারা প্রকৃত বন্ধু না তারা সময়ে-অসময়ে নানান রকম মিথ্যা বলে। নিজের পরিচিতি নিয়ে মিথ্যা বলে, পরিবারের আর্থিক অবস্থা নিয়ে মিথ্যা কথা বলে। এছাড়াও তারা বন্ধুর প্রতি দায়িত্ব এড়ানোর জন্য নানান রকম মিথ্যা অজুহাত খোঁজে। অন্যের ব্যক্তিগত কথা আপনাকে বলে।

কিছু বন্ধু আছেন যারা অন্যের ব্যক্তিগত কথা কিংবা গোপনীয় নানান বিষয় আপনার সাথে বেশ আগ্রহ সহকারে আলাপ করে। কেউ হয়তো তাকে বিশ্বাস করে কিছু কথা বলেছিলো। সে এসে আপনাকে সব জানিয়ে দেয় এবং সেটা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। যে সব বন্ধুরা অন্যের গোপনীয় কথা আপনার সাথে আলোচনা করে, তারা আপনার গোপনীয় বিষয়ও অন্যের কাছে গিয়ে বলে দেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই এ ধরণের বন্ধুদেরকে বিশ্বাস করা ঠিক না।

একজন বন্ধু যদি সারাক্ষণ বন্ধুর অপর দোষ ধরে তাহলে সে প্রকৃত বন্ধুত্ব নয়। কিছু মানুষ আছে যারা সারাক্ষণই বন্ধুকে বিভিন্ন কারণে দোষারোপ করতে থাকে। বন্ধু এটা করেনি কেন, ওটা করেনি কেন, ফোন দেয়নি কেন ইত্যাদি নানান অভিযোগে জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে এধরনের বন্ধুরা। অনেকে আবার বিনা কারণে নানান রকম বাজে সমালোচনা করে চেহারা, চাকরি, পরিবার, প্রেম ইত্যাদি নানান বিষয় নিয়ে। একটা ব্যাপার মাথায় রাখবেন, আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যার নানান রকম অভিযোগ, তিনি কখনোই প্রকৃত বন্ধু নন। আড্ডায় ঠাট্টাচ্ছলে হলেও যে আপনাকে হেয় করার চেষ্টা করে, সে কখনো প্রকৃত বন্ধু নয়। বন্ধুত্ব মানে যে যেমন, তাকে সেভাবেই মেনে নেয়া। বন্ধুর সম্মানকে নিজের সম্মান মনে করা।
তবে এটাও ঠিক যে বন্ধুর মতো বন্ধু হয়ে থাকে বলেই বন্ধুত্ব শব্দটা এতো বন্ধু।

তাই হয়ত কবিতা লিখেছেন কবি, গীতিকার বেঁধেছেন গান -
একটাই কথা আছে বাংলাতে
বুক আর মুখ বলে এক সাথে
বন্ধু...বন্ধু...বন্ধু...আমার!

(কৃতজ্ঞতা - জীবন অভিজ্ঞতার কাছে আমি ঋণী আর বন্ধু নিয়ে নানান ফিচার পড়ে, আর ইতিহাস থেকে নেওয়া।)
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours