কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

বয়স যখন দুই, তখনই ঢপবাজির হাতেখড়ি। পাঁচ-ছয়ে পৌঁছতে না পৌঁছতেই মোটামুটি মাধ্যমিক। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট সাত- আটেই। এমনই লাফিয়ে লাফিয়ে প্রোগ্রেস।

একশোর মধ্যে নব্বইটা বাচ্চারই এই হাল। একেবারে হাতেকলমে গুলবাজি শিখে ফেলা। বড়দের থেকেই শেখা। আসলে গুলগাপ্পি মারাটাও, বড় হয়ে ওঠার এক লক্ষণ।

"মইয়া মোরি, ম্যায় নেহি মাখন খায়ো !"

অনুপ জলোটার সেই কালজয়ী ভজন মনে আছে তো?

ননীচোরা কানাই। একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে মা যশোদার কাছে। তখনও মুখে হাতে ননী মাখামাখি। তবু মা যশোদাকে সমানে বুঝিয়ে চলেছে, সে মাখন খায়নি। দেবশিশু বলে কথা। ঢপ মারাতে মানবশিশুদের থেকেও ওস্তাদ খুদে কৃষ্ণ।

অনেক স্বপ্ন বাচ্চাদের। কল্পনার ঘুড়ি আকাশে। কোনও সীমা- পরিসীমা মাপামাপির ধার ধারে না। একটু প্রশ্রয় পেলেই হলো। আর উসকে দিলে তো কথাই নেই। মনমাধুরীর ঘুড়ি পৌঁছে যায় গ্রহ নক্ষত্রের দেশে। খোকা যেন কবিগুরুর সেই 'বীরপুরুষ'। টগবগিয়ে চলেছে রাঙা ঘোড়াতে। মাকে বাঁচাতে খোকা একাই লড়ে গেলো ঝাঁকড়া চুলো, কানে জবাফুল গোঁজা ডাকাতদলের সঙ্গে।

"ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল

কী দুর্দশাই হতো তা না হোলে !"

স্বপ্নজগতের নিষ্পাপ মিথ্যাবর্ণন।

কল্পনার দৌড়ে এই কচিকাচারাই চ্যাম্পিয়ন। তাদের এই গুলবাজি আসলে স্বপ্নপূরণের অজুহাত। অনেক সময় অবশ্য কেউকেটা সাজতেও গপ্প ফেঁদে বসে। অথবা  হতে পারে নিজের পিঠ বাঁচানো। তবে কাজ হাসিলের ঢপ মারা শেখে আরেকটু পরে। বয়স তখন চার কী পাঁচ।

বাচ্চাদের গুলবাজি মারার এই প্রবণতা নিয়ে এক মজার এক্সপেরিমেন্ট করেন ইউনিভার্সিটি অফ টরেন্টোর এক সাইকোলোজিস্ট কেং লি।

একদল বাচ্চা। লি কিছু খেলনা এনে একটা বাক্সে ঢাকা দিয়ে রাখলেন।

"বাক্সে কী খেলনা আছে, কাউকে দেখানো হবে না," বললেন লি। "অডিও ক্লু শোনানো হবে। আর তা শুনে বলতে হবে খেলনাটা কী।" মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো বাচ্চারা। তারা কেউ ওই বাক্সের ঢাকা সরিয়ে কিচ্ছুটি দেখবে না। এবার শুরু হলো অডিও ক্লু দেওয়ার পালা।

সাউন্ড সিস্টেমে প্রথমেই কুকুরের ঘেউ ঘেউ।

"কুকুর কুকুর!" চেঁচিয়ে উঠলো খোকাখুকুর দল।

এবার "মিউ মিউ"। বাচ্চারা সমস্বরে জানিয়ে দিলো, "বেড়াল"।

তারপরেই এক ফাঁদ পাতলেন লি। সাউন্ড বক্সে বেজে উঠলো বিঠোভেন। বাচ্চারা চুপ। এ ওর মুখের দিকে তাকায়। বেচারাদের মাথায় ঢোকেনি বিঠোভেনের সিম্ফনি।

"ওফ, ঠিক এখনই ফোন কল," বললেন লী। যেন খানিকটা বিরক্ত। বাচ্চাদের বললেন, "আমি ফোন কল অ্যাটেন করেই ফিরছি।" রুম থেকে বেরনোর আগে তিনি সবাইকে বলে গেলেন, "কেউ কিন্তু ওই বাক্সের ঢাকা সরিয়ে খেলনা দেখবে না।"

গোটাটাই নাটক। লি আসলে বাচ্চাদের সুযোগ করে দিলেন বাক্সে উঁকি মারার। আর বাইরে গিয়েই চোখ রাখলেন ওই রুমের ভেতর লাগানো ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ছবিতে। সব দেখেশুনে মুচকি মুচকি হাসলেন তিনি।

একটু পরেই ফিরলেন লি। "কেউ দেখনি তো বাক্সে কী খেলনা রাখা আছে?"

"নো স্যার।" জোর গলায় জানালো বাচ্চারা। নির্ভেজাল মিথ্যেকথা বলতে একটুও গলা কাঁপলো না নানাবয়সী বাচ্চাদের। ফেঁসে গেলো লি'র বেছানো ফাঁদে।

ঠিক কতজন বাক্সে উঁকি মেরেও বলেছিলো মারেনি?

যাদের বয়স দুই ছুঁই ছুঁই, তাদের প্রতি একশোজনের মধ্যে তিরিশজনই বাক্সের ঢাকা সরিয়েছিল। বোঝার চেষ্টা করেছিলো, ঠিক কোন খেলনা থেকে ওই বাজনা বাজছিলো।

তিনের মধ্যে যারা, তাদের পঞ্চাশ জনও একই চালাকি করেছিল। আর যারা সাত আটের, তাদের মধ্যেও আশিজনই বাক্সে উঁকি মেরেছিল।

কিন্তু এদের সবাই সরাসরি বাক্সের ঢাকা সরানোর কথা অস্বীকার করে নির্জলা গুল মারলো। সমীক্ষা শেষে একগাল হেসে লি বলেছিলেন, "দেখলেন তো, সময় মানুষকে কত কিছু শেখায়।" সময় যায়, বয়স বাড়ে। কমে আসে সত্যের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর মুরোদ। আশ্রয় মিথ্যার।

ঢপবাজিতেও ওস্তাদি আছে। আর সেই ওস্তাদি শেখে বয়স বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে।  তিন চার বছরের বাচ্চারা দুম করে বলে দিলো, "না, ঢাকা সরাইনি।" তাদের এই গুলবাজি যে স্যার ধরে ফেলতে পারে, সেকথা তাদের মাথাতেও এলো না। কিন্তু এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধানী তাদের বড়রা। সাত আট বছরের বাচ্চারা তাদের অপকর্ম ঢাকতে, ইচ্ছে করেই ভুলভাল খেলনার কথা বলেছিল। আর কয়েকজন নানা কারণ সাজিয়ে এমনভাবে খেলনার ঠিক নামটা বললো, যাতে মনে হয় গোটাটাই 'গেজ ওয়ার্ক'।

কিন্তু পাঁচ ছয়ের বাচ্চারাই বা কতটা যুধিষ্ঠির?

লী একটা খেলনা ডায়নোসর নিয়ে বললেন, সবাই চোখ বোজো। এরপর তিনি খেলনাটা কাপড়ে ঢাকলেন। পাঁচ ছয়ের বাচ্চা মেয়েদের জিজ্ঞেস করলেন, কেউ উঁকি মেরে দেখনি তো। সবাই চেঁচিয়ে জানালো, নো স্যার। লী এবার একে একে তাদের ডেকে জানতে চাইলেন খেলনার নাম বলো। প্রথমে যে মেয়েটা এলো, সে বললো, স্যার কাপড়ের তলায় একবার হাত দেব। লী বললেন, চোখ বন্ধ করে হাত দাও।  মেয়েটাও তাই করলো। তারপরেই বললো, "বুঝে গেছি।" লী জানতে চাইলেন বলো দেখি কী আছে?

- ডায়নোসর।

- কিভাবে বুঝলে?

- ওটার রং সবুজ।

চোখ বুজে, শুধু হাত দিয়েই খেলনার রং ঠিকঠাক বলে দিলো সেই মেয়ে।

সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে যুক্তি দিয়ে মিথ্যা বলার পরীক্ষায় পাস। তার মানেই, "আমি বড় হচ্ছি মাম্মি"। সবে তখন দুনিয়াটাকে বুঝতে শেখা শুরু। কী করলে মায়ের ধমক খেতে হবে, তা ততদিনে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। তাই সেরকম কোনও অপকর্ম করে ধরা পড়লেই গুলবাজি- "বিশ্বাস কর মাম্মি ফুলের টবটা আমি না, বিট্টু ভেঙেছে।"  সত্যি কথা বললেই বিপদ। মগজ তখন সঙ্কেত পাঠানো শুরু করেছে। সুতরাং মারো ঢপ।

এছাড়াও তখন অন্য আরেক বিদ্যা রপ্ত করতে শুরু করেছে ছোট্টরা। ঠিক কোন কথা বললে মা বিশ্বাস করবে। আর কোন কথা বললে, বিশ্বাস করবে না। মায়ের থট রিডিং। তখন সেই মতো যুক্তি তথ্য খাড়া করে ফেলে বাচ্চারা। তিন চার থেকেই বেশ ওস্তাদ হয়ে ওঠা শুরু তাপ্পি মারাতে।

কিন্তু বাচ্চাদের এই ডিং হাঁকার ট্রেনিং দেয় কে?

কেন মগজ স্যার। মগজের প্রাথমিক কাজগুলির মধ্যে এটাও পড়ে। তবে অটিজিমে ভোগা বাচ্চাদের বেলায় মগজের এই মাস্টারি খাটে না। আর তাই তারা মিথ্যা বলায় সেভাবে চকচকে ঝকঝকেও হয়ে ওঠে না।

অতএব, সাধু সাবধান। নিষ্পাপ, পুতুলের মতো সুন্দর দেখতে ছানাটার মনভোলানো সবকথায় বিশ্বাস করবেন না। তবে ওর গুলবাজিতে অস্থির হয়ে উঠলে, নিজে অন্তত একবার আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন। কারণ ঢপবাজির বিদ্যা ও মায়ের পেট থেকে শিখে আসেনি। শিখেছে ওর গুরুজনের অনুপ্রেরণাতেই। কাল সেই গুরুজনদের গুলবাজির কথা শোনাবো।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours