গৌতম দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, রাজ্য আবগারি দফতর ও লেখক, কলকাতা:

সম্প্রতি মহারাষ্ট্রে চলতে থাকা সুপারহিট রাজনৈতিক যাত্রাপালা সবার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে! হাস্যকর ব্যাপার কে যে কার হাত কখন ধরছে, কার হাত কখন ছাড়ছে, কখন কি কারণে কে কাকে ছুঁয়ে আউট করে দিচ্ছে, এসব কিছুই সহজ বুদ্ধিতে বোঝা সম্ভব নয়! খানিকটা কানামাছি খেলার মতো! দেখার দরকার নেই, বোঝার দরকার নেই, হাত ধরে নিলেই হলো!  এবারের শিবসেনার সাথে কংগ্রেসের এই জোটের মূল যোগসূত্র অবশ্যই এনসিপি প্রধান বিখ্যাত 'আয়ারাম-গয়ারাম' শরদ পওয়ার, যার এই দল-বদলের বিষয়ে চিরাচরিত করিশমা আছে! বলতেই হচ্ছে শরদ পওয়ার কিন্তু বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখিয়ে দিলেন! যদিও এই হঠাৎ তৈরি জোট সরকারের আয়ু কতদিন হবে কেউ জানে না!  ইতিহাস কিন্তু বলছে এই ধরনের সরকার বেশি দিন টেকে না! যেখানে শুধু ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য জোট হয়, সেই জোটের ভবিষ্যতও সব সময় অনিশ্চিত হয়! যাইহোক শিবসেনা সভাপতি উদ্ধব ঠাকরে এবং কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর মধ্যে দুরত্ব ঘোচাতে এবার তিনিই কিন্তু  বড়ো ভুমিকা নিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে! শিবসেনা আর কংগ্রেসের এই জোট দেখে অবাক হবার কোনো কারণ নেই!  এর আগেও বারবার এই ধরণের ঘটনা ঘটেছে:- বিজেপি আর তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং পুরানো জোট সঙ্গী শিবসেনার মধ্যে এই প্রথমবারই সম্পর্কের অবনতি বা স্বার্থ-সংঘাত  তৈরি হয়েছে তা কিন্তু নতুন নয়! গত তিরিশ বছরে এই জোট অনেকবার বিচ্ছিন্ন হয়েছে আবার জুড়েও গেছে।  শিবসেনা এবং বিজেপি 1989 এ মহারাষ্ট্রের লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের জন্য প্রথমবার জোট বেঁধেছিল, 1999 এ দুজনে একসাথে মহারাষ্ট্রে প্রথম সরকার গঠন করেছিলেন।  কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে দুটি দলই একসাথে 2014 পর্যন্ত বিরোধী দলে বসেছিল।
কিন্তু এই বছরগুলির মধ্যেও  শিবসেনা বেশ কয়েক বার বিজেপি কে কিন্তু বিপাকে বা অস্বস্তিতে ফেলেছে!   2007 এ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়, শিবসেনা বিজেপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটের (এনডিএ) প্রার্থী ভায়রন সিং শেখাওয়াতকে সমর্থন না দিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ জোটের (ইউপিএ) প্রার্থী প্রতিভা পাতিলকে সমর্থন দিয়েছিল, এর পেছনে অবশ্যই কিছু ঘটনা ছিল, তবু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইউপিএ প্রার্থীকে সমর্থন করার শিবসেনার এই পদক্ষেপ রাজনৈতিক মহলে বেশ আলোড়ন শৃষ্টি করে ছিল।  এরপর কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএর রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন করে এবং এনডিএর পিএ সঙ্গমাকে সমর্থন না করে যখন শিবসেনা 2012 তেও আবারও একই রকম ঘটনা ঘটায় তাই আর কেউ আশ্চর্য হয় নি! এবারের জোট যেভাবেই হোক না কেন, তাই হতবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই! ভারতবর্ষে এই ঘোড়া কেনাবেচা এবং দলবদল বা জোট বদল দেখতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে! ভারতবর্ষে সরকার গঠনের জন্য বা পরিস্কার করে বলা ভালো যে রাজনৈতিক ফয়দা অর্জন করার জন্য, বারবার মতাদর্শগত ভাবে বিপরীত মেরুতে থাকা দল বা চিরশত্রুদের একত্রিত হওয়ার একধিক চমকপ্রদ উদাহরণ আছে,  এমনকি বিজেপি এবং কংগ্রেসের মধ্যেও জোট হয়েছে! মিজোরামের চাকমা স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদে 2018 সালে কুড়ি সদস্যের কাউন্সিলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে বিজেপি নেতৃত্বাধীন উত্তর-পূর্ব গণতান্ত্রিক জোটের (এনইডিএ) অন্যতম সদস্য মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট আট সদস্য নিয়ে একক বৃহত্তম দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল আর কংগ্রেস পেয়েছিল সাতটি এবং বিজেপি পাঁচটি। এরপর আশ্চর্যজনক ভাবে কংগ্রেস এবং বিজেপি একটি পোল-জোট গঠন করেছিল, এমনকি এই জোটের নাম দিয়েছিল, ইউনাইটেড লেজিসলেচার পার্টি!  কংগ্রেস দলের সেই নির্বাচিত সদস্যরা এই পদক্ষেপের বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে দিকনির্দেশনাও চেয়েছিলেন, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তখন স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে বিষয়টি স্থানীয় ভাবে মিটিয়ে নিতে পরামর্শ দেয়, তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিজেপির সাথে এ জাতীয় চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবে না বলে জানিয়ে দেন!  শেষপর্যন্ত, কংগ্রেস এবং বিজেপি স্থানীয়ভাবে চাকমা স্বায়ত্তশাসিত জেলা কাউন্সিল সরকার গঠনের জন্য একত্রিত হয়েছিল, তারপর 2019 এর ই আগস্ট মাসে কংগ্রেসের তিনজন সদস্য আবার বিজেপি তে যোগও দিয়ে দেয়।   2014 এর জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভা নির্বাচনে প্রয়াত মুফতি মোহাম্মদ সৈইদ এর মেয়ে মেহবুবা মুফতির পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (পিডিপি) সাথে বিজেপি আরও এক অবাক করা জোট গড়ে তুলেছিল, উভয়পক্ষের অসংখ্য বিপরীত মতাদর্শগুলি কে দুরে সরিয়ে রেখেই জোট হয়ে যায়!  বিজেপি অতীতে এই পিডিপিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী দল বলে বারবার অভিযোগ তুলেছিল।  একদিকে জম্মু ও কাশ্মীরে বিজেপি যখন 370 ধারা বাতিল করার জন্য প্রচার চালাচ্ছিল অন্যদিকে, পিডিপি এই বিষয়টি সন্তর্পণে এড়িয়ে যাচ্ছিল! একেই বলে জোট বড়ো বালাই!  একজন প্রথমসারির বিজেপি নেতা রাম মাধব পিডিপির সাথে সরকার গঠনের জন্য আবার একটি চুক্তিও করেছিলেন।  2018 সালে অবশ্য এই দুই দল যথারীতি পৃথক হয়ে যায়, কারণ এই অসম্ভব বোঝাপড়া বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি!  কংগ্রেস দলও এই একই ধরণের চমকপ্রদ জোট তৈরিতে কিন্তু পিছিয়ে নেই!  2013 এ দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল আম আদমি পার্টি।  সেই সময় সদ্য প্রতিষ্ঠিত আম আদমি পার্টির (এএপি) প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এই সম্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্বও দেন।  সেবার ফলাফল বেরোলে দেখা যায় দিল্লিতে বিজেপি একক বৃহত্তম দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং  দ্বিতীয় স্থানে ছিল আম আদমি পার্টি,  কংগ্রেস ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল,  মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।  অবশ্য বিজেপি সরকার গড়ার দাবি না জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে, নির্বাচনের ময়দানে যুযুধান কংগ্রেস আর অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি (এএপি) অদ্ভুত ভাবে এক হয়ে গেছিল! সরকার গঠনের জন্য এএপিকে বাইরে থেকে সমর্থন জুগিয়েছিল এই কংগ্রেস দলই !  লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই এসব তো ভারতবর্ষে রোজ ঘটে!  2018 সালে, কংগ্রেস কর্ণাটকে জনতা দল (সেকুলার) দলকে সমর্থন করার জন্য একটি আশ্চর্যজনক ঘোষণা করেছিল, যেখানে বিজেপি একক বৃহত্তম দল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল তবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাব ছিল। সেই সময় কিন্তু জেডিএসের নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, কংগ্রেস আর জেডিএস এর মধ্যে ছিল তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতা আর সংঘাত,  জেডিএস এর নেতারা এইচডি দেভে গৌড়া এবং তাঁর পুত্র এইচডি কুমারস্বামী সেই সময় বেশ কয়েক বছর ধরে কর্ণাটকে বিজেপির চেয়ে বরং কংগ্রেসের তীব্র সমালোচক ছিলেন,  তবুও কংগ্রেস সব অতীত যুদ্ধ ভুলে, মান অভিমান দুরে সরিয়ে রেখে শুধু বিজেপিকে হটাতে জেডিএসকে নিঃশর্ত সমর্থন ঘোষণা করেছিল! এখানেই শেষ নয় আরও আছে!!  অতীতে বিজেপি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মায়াবতীর বিএসপি পার্টির সাথে বারবার জোট গঠন করেছে। মায়াবতী 1995 এ মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, যদিও এই এসপি ও বিএসপি জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন মুলায়ম সিং যাদব। 1993 তে উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের জন্য দুটি দলই জোট বেঁধেছিল আবার 1995 এ মায়াবতী সেই সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিলে তিক্ততা আর অশান্তি চরমে ওঠে এই দুই দলের মধ্যে, এসপি-বিএসপি সরকার ভেঙে পড়লে এই মায়াবতী বিজেপি এবং জনতা দলের বাইরে থেকে সমর্থন নিয়ে আবার শপথ নেন! তারপর আবার সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে আমরা দেখলাম এসপি-বিএসপি হাত মিলিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করলেন, যদিও সেই লড়াই শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। এবারের শিবসেনা এবং কংগ্রেসের জোটের মতোই বিএসপি এবং বিজেপি ও বিপরীত মতাদর্শের রাজনৈতিক দল, তাই অনেকেই এই জোটকে কটাক্ষ করে বলছে ব্যক্তিগত স্বার্থের জোট!!  পশ্চিমবঙ্গে এই সংস্কৃতি সেভাবে ছিল না, কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের এর হাত ধরে এই সংস্কৃতি প্রবেশ করে, কখনও বিজেপি কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে তারা জোট করেছে! সবথেকে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং চিরশত্রু কংগ্রেস আর বামফ্রন্ট এর সাম্প্রতিক জোট!  তিরিশ বছর আগে এই জোট হওয়ার সম্ভাবনা আর মঙ্গল গ্রহে মানুষ থাকার সম্ভাবনা একরকম ছিল!  আজ যে বিজেপি তৃণমূল প্রতিদিনই রাজনৈতিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে, দু-দলের অনুগামীদের খণ্ড-যুদ্ধে সাধারণ মানুষ দিশেহারা, এরাই যে এক সময় এক সাথে কেন্দ্রে সরকারে ছিল কে বলবে ! আবার ভবিষ্যতে একসাথে হবে কিনা তাও আমারা কেউ জানিনা যেমন এই বাম-কংগ্রেস জোট আদৌ পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচন  পর্যন্ত টিকবে কিনা সেটাও দেখার বিষয়! রাজনীতিতে সবই সম্ভব!  আমরা এখন আর কিছুতেই অবাক হই না, অভ্যস্ত হয়ে গেছি!




Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours