নাজমীন মর্তুজা, লেখক ও গবেষক, অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া:
সমাজে প্রেম ভালবাসা যেমন আছে, তেমনি আছে ঈর্ষা।
কবি জীবনান্দ দাস, তাঁর কবিতায় সুন্দর ভাবে ঈর্ষাকাতর প্রেমিক, অন্য যুবকের সাথে সুরঞ্জনার কথা বলা নিয়ে চিন্তিত, ঈর্ষান্বিত ছিলেন তা প্রকাশ করেছেন।
আমরা সবাই সেই কবিতা পড়েছি কম বেশী --“সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;”
শুনতে যতই খারাপ লাগুক না কেন- ছলনা, বিশ্বাসঘাতকতা, ঈর্ষা বা জিঘাংসার মত বৈশিষ্টগুলোর জন্মও হয়েছে প্রেমের মতই একই বিবর্তনীয় যাত্রাপথে।
ঈর্ষা আসলে একটি সারভাইভাল স্ট্র্যাটিজি – বেঁচে থাকার এক সুচতুর পরিকল্পনা।
আসলে বিবর্তনের ধারাবাহিকতাতেই ভালবাসার মত ঈর্ষার বীজও মানুষের মনে তৈরি হয়েছে, এর পরিস্ফুটন ঘটেছে।
ঈর্ষার ব্যাপারটা বহুলাংশেই সময় এবং পরিস্থিতি নির্ভর।
পুরুষেরা ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠে যদি তার সঙ্গীর সাথে কোন তৃতীয়পক্ষের যৌনসম্পর্কের কোন আলামত পাওয়া যায়। কিন্তু মেয়েদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, তারা বেশি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠে যদি তার সঙ্গী অন্য কোন মেয়ের সাথে আবেগী কিছু করলে – যেমন টাংকি মারা, রোমান্টিক সম্পর্কে জড়ানো, চুমু খাওয়া, এমনকি এগুলো কিছু না করে তার সঙ্গী পুরুষটি অন্য নারীর সাথে কেবল দীর্ঘক্ষণ ধরে কথাবার্তা বললেও সে ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠে।
ফেসবুকের কল্যানে আমরা এখন অবাধে একটা শব্দ ব্যবহার করছি সেটা হলো বন্ধু। না বয়স না সামাজিক সম্পর্ক না জাত-পাত , না শ্রেণী সমতা , না ভালো মন্দ কোন কিছুই আলাদা না করে ঢালাও ভাবে বলছি । আরে উনি হ্যাঁ উনি তো আমার এফ বি বন্ধু । বন্ধু ! আমরা কতই না চমৎকৃত হচ্ছি আজকাল , জুকা ভাইয়ের যাদুর বাক্সে নিজেদের সমবায় সমতায় এক করে পুরো দুনিয়ার তাবৎ মানুষ কে বন্ধু বানিয়ে, "একটা ইমেইল আই ডি আর পার্সওয়াডের চাবি মাইরা দিছি ছাইড়া ... ঘুরতে আছে পৃথিবী জুড়ি। ও হো ... আমরা পৃথিবী জুইড়া বন্ধু গড়ি।”
কত কি দেখবো এখানে - পুরোনো বন্ধু কে পেয়ে যতটা উচ্ছ্বাসে গদ গদ হই .. চলে দিন কতক লাইক কমেন্ট .. আহা -ইস -অসাম -জটিল , সেইরকম , অনবদ্য- অনন্য- মুগ্ধ । কিছু দিন পর শুরু হয় ইর্ষার বিষে কাটা , তারপর সম্পর্কটার পুরো গ্যাংরিন করে ছাড়ে। কমেন্ট লাইক তো করবেই না , নিরবে সিসি ক্যামেরায় ছবি দেখে যাবে , গ্রুপে গিয়ে বিষ ফোঁড়ায় কাঁটা ফুটিয়ে দেবে । আর বলো না ! ছি : কি ভুল করছিলাম যে এড করতে গেলাম । কি বাজে প্রোফাইল , ছি : ভীষন বাজে , বিচ্ছিরি এতো এতো লাইকের জন্য কত যে ন্যাকা করে । আমরা পারি না বাবা , এতো রঙ্গ করে সঙ্গ বাড়াতে।
কি ছিল দেখিনি আমরা , এখন এফ বিতে এসে নিজেকে যেন .. আওডি হোপবার্ন ভাবছে । চামচিকারে কে বসাইছে সভ্য সমাজে । ভাগ্যিস এফ বি আসছে , তা না হলে জানতাম ই না !কত লীলাবতী!
এবার আসি আপনার গোপন প্রেমের ডুবে ডুবে জল খাওয়া রাডার বাসির দৃষ্টি আপনাকে কি করে সিসি নজরে রাখছে।
শালা আমি এতো জটিল কমেন্ট দেই .. লাইক দিয়ে ছেড়ে দেয় , ঐ বুড়া হাবড়া মাজা ভাঙ্গার লগে যতো কথা।
রঙ্গ পুরাই ... দিনে দুবার চিরকুট স্টাটাস ! ডিপি চেন্জ । আমরা বুঝি না , কিসের রাসলীলা , নায়িকা হইছে যেন মুভিতে নামছে । শালি /শালা কত জনের যে মাথায় লাড্ডু ফুটাচ্ছে কে জানে!
আত্মীয় স্বজন শুধু প্যাঁচার মতো দেখবে .... কত দূর অধ:পতন , পোষাক ,চালচলন , স্ট্যাটাসের ইস্যু , মানুষের কমেন্ট , লাভ রিয়েক্ট , শব্দের শ্লীলতা অশ্লীলতা । বাসার আসবাব পত্র , কোকারীজ , জুয়েলারী , শাড়ি , মাথায় ঢাকা দিচ্ছে কিনা , আল্লাহ খোদার নাম নেয় কিনা , কোথায় ঘুরতে গেল , কবে ফিরলো । এরই মধ্যে যদি একটা উদাস ছবি পোষ্টাইছেন , আর একটা গান ... “হয় যদি বদনাম হোক আরো আমি তো এখন আর নই কারো ! “ তবে তো তাদের আমরাইজ ... ঢাক বাজাবে মনে মনে !কেমন এইবার হইছে না !কথায় বলে “অতি বাড় বেড়ো না বাতাসে ভেঙ্গে যাবে —- অতি ছোট হইও না ছাগলে মুড়ে খাবে।“ এজন্যই বলে ... এতোটা ভালো না , পা মাটিতে রেখে চলা ভালো !
আরো আছে কারও সাথে আপনার কোন কারণে কমেন্ট নিয়ে বাক বিতন্ডা হলো , দুজনের মধ্যেই যেন সাপ মারার পর বিষ লেজে জিইয়ে রাখার মতো ব্যপার , সুযোগ পেলেই ব্যস কামড় বসানো।
তুলাধুনা করে দেবে। দেখবে না সাত পাঁচ । ভালো মন্দ , ন্যায় অন্যায় । কমেন্টে বুক বরাবর ফায়ার করে জাস্ট নটিফিকেশন চেক করতে থাকবে , আর মাথার ওয়ালনাটেরবাটার বানাবে। তাড়িয়ে তাড়িয়ে ব্রেডের উপর আয়েস করে লেপন করবে!
কিছু মানুষ আছে যারা , আপনার ভালো ভালো বন্ধুদের হান্ট করবে , সরাসরি এড রিকু , তারপর সুযোগ বুঝে ব্যস গ্যাস ছেড়ে দেবে। আপনাকে দেখি অমুকের ওয়ালে কমন কমেন্টার , বেশ ভালো কমেন্ট করেন , আমরাও কিন্তু দু একটা কমেন্ট পেতেই পারি , লেখালেখি না করলেও ছবিতে ... যা হয় লিখলেন । আরে জানেন তো ! যাকে আপনি এতো বাটার মোলছেন ... আপনি কিছু জানেন না , এফ বি তে নায়ক / নায়িকা হয়ে গেছে , আপনি দেখছেন বন্ধু তালিকায় চেক করে । খোদা !সব হেদু গেদু চা দোকানদার, পুলিশ , শাড়ি বেচা , মহিলারা , এরাই তো অন্ধের মতো কমেন্ট করে , দেখেছেন কোন ইন্টেলেকচুয়াল কমেন্ট , সব ঐ আহা উফ, দারুন, সেই, যেন মুজরা করতে বসছে , ছি : অধ:পতন । যাহ বাব্বা! কমেন্ট কারি পারলে তখ্খনি সব কমেন্ট ডিলিট দেয় তো বাঁচে , মনে করে আর ঐ উঠান মারাবেই না।
এরপর আরো আছে ,কিছু ... আপু / ভাইয়া .. আপনার স্ত্রীর বা স্বামীর ছবি কখনো দেন না কেন , রিলেশন বুঝি ভালো নয় , দেখলাম আপনার স্ত্রীর আই ডি তে গিয়ে , ইস কি ভালো রাখেন আপনি , আর কিনা আপনার খোঁজ নেয় না , পারে তো বুকের উপর বালিশ পেতে দেয় ।আপা আপনার স্বামীতো দেখতে প্রজেন্টেবল না , বুঝছি এ কারণেই তার সাথে ছবি পোষ্টান না , ইসস রে পরির মতো মানুষের , কপালে এইডা কি জুটছে । সবই কপাল , ভালো মানুষের কপালে ভালো জিনিস জোটে না । মাওলার হিসাব বোঝা দায় । আপনার জন্য খুব মায়া আমার আপা । বন্ধু হতে চাই । হাত টা ধরতে চাই ,সুখে দুখে হাসি কান্নায়।
জগতের সকল শান্তি নদীর নহর যেন তার বুকেই বহে।
বান্ধবীর বর যদি লাভ রিয়েক্ট দিয়েছে ... তবে আপনার শান্তির মা মারা যাওয়ার আগেই আপনি কবরে বিছানা পাতবেন।
কারো পরকিয়া বন্ধু যদি লাইক দিয়েছে তো অধিকের উপর দুধভাতের স্বাদ ঐ দিন থেকে বন্ধ।
মন উঠে গেছে না , ঐ মহিলার সাথে কি ? সব সময় দেখি লাইক করো ! আমাকে আর ভালো লাগে না তো ! যদি লাইক দিছ তো তোমাকে বিদায় হজ্জে পাঠাবো , মনে রাইখো।
বেচারা বলবে আপা আপনারে যে কত ভালো লাগে লিখতে পারি না , নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা ,কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি আপনার প্রতিটা পোষ্ট পড়ি।
কত যে মন দিয়ে আপনার ছবি দেখি। এতো সুন্দর আপনি । দেখেই ওম শান্তি!
আমি ভাবতেই পারি না আপনার মতো মানুষ খালি আছেন?
কিছু মানুষ আছে হুদা রাম , একসময় আপনার সাথে কথা হতো আড্ডা হতো , এখন শুধু নিরবে দেখে ।তাল গাছ এক পায় দাঁড়িয়ের মতো। বোবা ! না লাইক না কমেন্ট না ইনবক্স , মরে গেলেও RIP লিখতেও যেন বাধে । কিন্তু এদের যুক্তি শুধু নির্বাক নয়নে দেখেই যাবো , বলবো না কিছু । এরা শত্রু মিত্র কি পার্যায়ের বন্ধু বোঝা মুশকিল!
এক শ্রেনীর বন্ধু আছে ... আসতে যেতেও সালাম শুভসকাল শুভ বিকেল , গান , হাদিস , ফুল , পাখির ডাক সব বিলাতে বিলাতে এক সময় বমি করবে আসল উদ্দেশ্য । আমরা এটা করছি সেটা করছি পাশে থাকুন । বড্ড প্রয়োজন কিছু টাকা হবে।
আর সবচাইতে যারা ভয়ঙ্কর ,তারা আপনার খুব কাছের আত্মীয় স্বজন , না লাইক না কমেন্ট না আপনার সফলতার হাততালি দেবে না আপনার বিপদে হাত বাড়িয়ে তুলবে , শুধু ভ্রু ভঙ্গী বক্র করে দেখবে।
আর প্রাইভেট গ্রুপে বাকবাকুম করবে সাবজেক্ট আপনি , মেইন , সাবসিড্য়ারি দুই বিষয় আপনাকে নিয়েই , ভজন চলবে । টিকা টিপ্পনি দেবার জন্য আছেও কতক আদ্দালি , রুদালীর দল।
কিন্তু মুখের সামনে এমন ভাব যেন মধু ঢেলে দেয়। আর এফ বি তে চেনে না।
এরা সাংঘাতিক ... স্নিফার ডগের মতো , আপনার সমস্ত গন্ধ নেয়ার জন্য পেছনে লেগেই থাকে।
এবার সহপাঠি বা বাল্য কিশোর কালের বন্ধু বান্ধব , এবং সমসাময়িক কালের বন্ধু বান্ধবরা ঠিক সেই জায়গাতেই থমকে আছে , তারা ভাবে এক সাথে লুডু খেলেছি আর আজকে ও আর কি ! কত কুত কুত খেলছি , তারাও একই ২৫ বছর কে টেনে বর্তমানের পজিশনের সাথে আপনার ঘুড়ি কাটাকাটি খেলবে।
যেন এই দিনেরই নিয়ে যাবে সেই দিনের কাছে। পাবলিকলি এমন কমেন্ট করবে না রাখা যায় ধরা না যায় ছাড়া । কিছু বল্লেই গোস্যা করবে। গোস্যা হলে নিজের উপরে চাপ ফিল হয় , আহা রে ! আবাল কালের বন্ধু ! থাক বলেই রেখে দিতে হয়।
মানুষের মাঝে বেড়েছে অস্থিরতা কৃত্রিমতা, চাতুরতা, স্বার্থপরতা, তিক্ততা, হীনমন্যতা, ইর্ষা, ক্রোধ, অহমিকা, দাম্ভিকতা, অনাচার অবিচার, অকৃতজ্ঞতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনা, সমাজের মানুষ আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মানবতাবাদী ও আলোকিত মানুষ হতে পারে। নম্রতা, ভদ্রতা, বিনয়ী, উদারতা, সহমর্মিতা, সৌজন্যবোধ, মমত্ববোধ, শিষ্টাচার, সত্যবাদী, কর্তব্যপরায়ণতায়। কিন্তু
ব্যক্তির, মানবিক মূল্যবোধের আজ দারুন সংকট।
ঈর্ষা, হিংসা অথবা রেষারেষির বিষয়টা এত ভয়াবহ ফেসবুক এসে এই ব্যপারগুলো যেন আরো প্রকট হয়ে ধরা দিচ্ছে । কিছু কিছু মানুষ আছে যারা আসলেই ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী তারা ঈর্ষার শিকার হবে । এটা যেমন ঠাওর করা যায় , তেমন সেই ব্যক্তিও ওয়াকিবহাল থাকে।
সৃষ্টির সাথে সাথে ঈর্ষার ব্যাপারটিও চলে আসছে, নতুন না।
এই সব হিংসা দ্বেষ মাৎসর্য নিয়েই যুগে যুগে নানা যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই ছিল দেশে দেশে মানুষে মানুষে ।শেক্সপীয়ারের ওথেলো, হ্যামলেট, ম্যাকবেথও জুলিয়াস সিজারসহ আরো নানা ঘটনায় দেখতে পাই ঈর্ষার কত রূপ। কত নিরীহ মানুষ, বিষয় এবং দেশ ধ্বংসের সম্মুখীন । কত মধুর সম্পর্ক ঈর্ষার আগুনে জ্বলে সমাধির ঠিকানা পায় । আর এপিটাফে শুধু পরে থাকে সম্পর্কের নামটা।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours