শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:
অমিত শাহের একটি টুইটে সংস্কৃত ভাষা নয় ভারতে হিন্দি ভাষায় নিয়ে ফের বিতর্ক শুরু হয়েছে। তার আগে এই লেখার সারাংশ লেখার সুবিধার জন্য একটু বলে নিই।
গ্রীকদের ৩০ হাজার manuscripts ( হাতের লেখা বই)। তাতেই পৃথিবী গ্রীকদের জ্ঞানের সর্দার ভেবে নিলো, আমরাও মেনে নিলাম । অথচ, উদয়গিরি, তক্ষশীলা, নালান্দা সব জ্বালিয়ে দেয়ার পরও ৩০ লাখ! সংস্কৃত ভাষায় লেখা manuscripts আজো ভারতের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে সংগৃহীত আছে। যার অধিকাংশই অনুবাদ করা হয়নি। এ ছাড়া তামিল, তেলুগু ভাষায় তো রয়েছেই।
আমরা অনেকেই মনে করি সংস্কৃত ভাষায় কেবল বেদ, গীতা,উপনিষদ, মহাভারত লেখা! সংস্কৃত ভাষায় এই ৩০ লাখ হাতের লেখা বই কি কেবল ধর্মগ্রন্থ! বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য সহ জ্ঞানের অন্যান্য শাখার উপর কি বইগুলো লেখা হয়নি? ১৫ শতকে ছাপাখানা আবিস্কার হওয়ার আগে সাড়া দুনিয়ায় হাতের লেখা বই পড়া হতো। ভারতবর্ষের ( ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ।) মত এত হাতের লেখা বই পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি?
কারা ভারতবর্ষের মানুষকে এই জ্ঞানের ভান্ডার থেকে পাঠ নিতে বঞ্চিত করে রেখেছে? এই উপমহাদেশ যারা শাসন করেছেন তারা? নাকি ব্রাহ্মণেরা? নাকি ব্রাহ্মণ ও শাসক দুই গোষ্ঠীই? বিষয়টি গবেষণার।
সংস্কৃত ব্রাহ্মণের ভাষা (?) সনাতনিদের ভাষা করে রাখার কুফল কেবল সনাতনীরাই ভোগ করছে না। এর কুফল ভোগ করছে ভারত, ভারত উপমহাদেশ সহ সারা পৃথিবী। কেননা, গ্রীকদের জ্ঞান ভান্ডারের মত যদি ভারতবর্ষের দর্শন, জ্ঞান বিজ্ঞানও ভারতবর্ষ সহ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরতো, তবে আজকের পৃথিবী আরো অনেক এগিয়ে যেতো।
ভারতে ১৪ সেপ্টেম্বর হিন্দী ভাষা দিবস পালিত হয়৷ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ চান হিন্দী ভাষা জাতীয় ভাষা হোক। ভারতের গণপরিষদ হিন্দীকে সরকারী ভাষা হিসেবে গ্রহন করেছিলো; বলেছেন অমিত শাহ।
ভারতে হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা করতে গেলে ব্যাপক প্রক্রিয়া হবে, প্রতিবাদ হবে সাড়া ভারতেই। এটাই স্বাভাবিক।
আমার স্পষ্ট মনে আছে৷ তামিলনাডুতে আমি যখন প্রথম যাই চেন্নাই এপোলো হসপিটালের ফুটপথের চা দোকানীর সাথে হিন্দীতে কথা বলার সময়, সরাসরি আমাকে বলেন, "নো হিন্দি, ইংলিশ বলো ইংলিশ, নেহি তো তামমিল। নো হিন্দি, নো হিন্দি।" আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি হয়তো তিনি হিন্দি বুঝেন না বা জানেন না। আসলে তিনি হিন্দি জানতেন ও বুঝতেন। তবে, তখনো আমার তামিলদের নিজ ভাষার প্রতি টান ও অহংকারের বিষয় জানা ছিলো না। তাদের জাতীয়তা ভারতীয় হলেও তারা যে জাতি হিসেবে তামিল তা তারা ভুলে যায় না কখনো। এ বিষয়ে তারা কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে খৃৃষ্টান তা নিয়ে ভাবে না। এমন কি কংগ্রেস, কে বিজেপি কোন আঞ্চলিক দলের নেতা বা কর্মি তাও সাধারণত বিবেচ্য নয়। অনেকটা বর্তমান লাদাখের মত। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান এক হয়ে যায় নিজেদের স্বার্থে। কে বিজেপি, কে এনসি (ন্যাশনাল কনফারেন্স) কে পিডিপি তারা কাশ্মীরের অাঞ্চলিক দলের কেন্দ্রীয় অফিসের নির্দেশ মেনে চলতে চায় না।
আমি গত বছরও খুব বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি; ভেলোরে একটি সুপার হিট হিন্দি মুভির দর্শক অন্যরাজ্যের দর্শকের তুলনায় কম। অথচ, নিম্নমানের একটি তামিল মুভির দর্শক তুলনা মুলক অনেক বেশি। আমি খুব গভীর ভাবে লক্ষ্য করেছি দক্ষিণ ভারতের লোকেরা হায়াদারাবাদের ফিল্ম সিটি নিয়ে তাদের গর্বের সীমা নেই। এ বিষয়ে তারা (মহারাষ্ট্রের) মুম্বাইয়ের বলিউডকে থোরাই কেয়ার করে! দক্ষিন ভারতের বাসিন্দাদের শ্রীদেবী রেখা কে নিয়ে গর্বের শেষ নেই। বাস কনডাক্টর থেকে অভিনেতা রজনীকান্ত তো তাদের সুপার ষ্টার এবং কিংবদন্তি! একটি অনুষ্ঠানে রজনিকান্তের উপস্থিতিতে ব্যাংগালুরুতে একবার অক্ষয় কুমারকে সুপারস্টার বলে সম্বোধন করা হলে, মঞ্চে উঠে অক্ষয়কুমার প্রথমে সবিনয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কেন না, তাকে রজনীকান্তের সামনে সুপারস্টার বলা হয়েছে। কেন ক্ষমা প্রার্থনা করেন? কারন তিনি জানেন, তামিল এমন একটি জাতি তারা জাতীয়তায় ভারতীয় হলেও নিজদের কোন বিষয়ে কোন ছাড় দেবে না। তাই, ডিপ্লোমেটিক বক্তব্য দিয়ে দক্ষিন ভারতীয়দের মন জয় করে নেন। দক্ষীন ভারতীয়রা বিজেপিকে ভোট না দিলেও ইন্দীরা গান্ধীর চেয়ে কোন অংশেই কম গর্ব করেন না ; ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিজ্ঞানী প্রফেসর এ পি জে আবুল কালামকে নিয়ে।
আরো একটা উদাহারন দেই তামিলরা কেমন একজোট! আমার চোখে দেখা একটি ঘটনা । চেন্নাই হসপিটাল থেকে ১০/১২ মিনিটের পায়ে হাটার পথ। মডেল স্কুল রোডের রাতে একটি হোটেলের তিন তলায় দাড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি একদল লোক ছোট বড় নারীপুরুষ এক যোগে পাশের একটি হোটেলে আক্রমন করতে যাচ্ছে। দু একজন স্টাফকে পিটিয়েছেও। কতক্ষন পরপর ঠিল ছুড়তে দেখি হোটেলটির দিকে। পুলিশের গাড়ি এলো। কিন্তু পাঁচ মিনিট পর চলেও গেলো। বুঝা গেলো উত্তেজিত জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নিলেও পুলিশ উত্তেজিত জনতার বিরুদ্ধে কোন একশন নিতে নারাজ। আমি পরে নিচে নেমে যাই কি হয়েছে তা জানার জন্য। ঘটনা শুনে আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তামিল ভাষা খুব ভালো করে বুঝি না। ভবালাম আমার ভুলও হতে পারে। তাই বাংলা ভাষা ও তামিল ভাষায়,পারদর্শী একজন (বিহারের) হোটেল বয়কে নিচে ডেকে নেই। সে ঘটনা শুনে বলে, আপনি যা শুনেছেন তাই ঠিক। তাহলে, শোনা যাক বিষয়টি, একজন লোকাল ব্যাক্তি (স্থানীয় তামিল) হোটেলের জেনারেটর থেকে সংযোগ চেয়েছিলো যাতে বিজলি চলে গেলে, সে অন্ধকারে না থাকে। অবশ্য সে জন্য স্থানীয় তামিল বাসিন্দা পেমেন্টও দিতে চেয়েছিলে। কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষ তাতে সায় দেয়নি। বেশ কয়বার অনুরোধ করে ব্যার্থ হয়েছে। যার কারনে ক্ষেপে গিয়ে, সেই লোকাল ব্যাক্তিটি বলে, "শা... লা বন্ধ কর জেনারেটর। আমরা অন্ধকারে থাকতে পারলে তোরা পারবি না কেন? " এক পর্যায়ে হোটেলের কর্তৃপক্ষ পুলিশের ভয় দেখায়। এতে স্থানীয়রা আরো ক্ষেপে যায়। বলে," শা... লা, পুলিশ তামিল, আমরা তামিল এত দুর থেকে ব্যবসা করতে এসে আমাদের তামিল পুলিশ দিয়ে পেটাবি! " এতে হোটেল স্টাফও লোকাল তামিলদের ঝগড়া বেধে যায়। মনে হতে পারে এরা জংলি, আইন মানে না। কিন্তু আপনি তাদের ঐক্যবদ্ধতাকে শ্রদ্ধা করতেও বাধ্য! কি বলেছে, "আমরা বিজলি ছাড়া চলতে পারলে তোরা পারবি না কেন? তোরা বিজলির বিকল্প পেলে আমরা পাবো না কেন? ' পুলিশ,অতপর বিষয়টি মিমাংসা করার জন্য দুপক্ষের দুজনকে দায়িত্ব দিয়ে চলে যায়।
ঘটনা এ জন্য বললাম, যারা বিজলি ও জেনারেটর নিয়ে এমন লংকা কান্ড বাধাতে পারে। তারা ভাষা নিয়ে কত শ, লংকা কান্ড বাধাবে তা বলা মুশকিল। আমার মনে হয় না অমিত শাহ বা বর্তমান সরকারের হিন্দিকে রাষ্ট্র ভাষা করার চেষ্টা সফল হবে। দক্ষিন ভারতীয়রা তামিল, তেলেগু, কানডি ভাষার মর্যদার আসন হিন্দীর চেয়ে নিচে দেখতে চাইবে না। মেনে নেবেও না৷ এমন কি সমঝোতা করেও সম্ভব নয়। কেন না, হিন্দী ভাষার বয়স থেকে তামিল ভাষার বয়সও অনেক বেশি। কয়েক হাজার বছর পুরোনো তামিল, তেলুগু ভাষায় রয়েছে হাজার হাজার manuscripts । ঠিক তেমনি, তামিলদের মতই, বাঙালি,গুজরতি, মারাঠিরাও, তাদের ভাষার উপর হিন্দীর কর্তত্ব নাও মেনে নিতে পারে।
পাকিস্তানী পাঞ্জাবীদের মত বেলুচ, সিন্ধি, পশতুনদের উপর যে ভাবে উর্দূ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সে ভাবে ভারতে অসম্ভব। কেন না, ভারত একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট। পুর্ব পাকিস্তানে ১৯৫২ সালে পরাধীন বাঙালির উপর ধর্মের দোহাই দিয়েও জোর করে বাংলার বদলে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়া যায়নি। আর তো ভারত স্বাধীন ও গনতান্ত্রিক, সেকুলার দেশ।
ভারতের ২৯ টি রাজ্যের মধ্যে হিন্দী কয়টি রাজ্যের রাজ্য ভাষা? বর জোড় সাত আটটি রাজ্যের রাজ্য ভাষা। ভারতে, ইংরেজি,উর্দু, মনিপুরি, অসমিয়া, কঙ্কোনী, উড়িয়া, মারাঠী,মিজো, মলায়ালম, তেলুগু, কানাডি, উর্দু, পঞ্জাবী,গুজরাতি,বাংলা, হরিয়ানভি প্রভৃতি রাজ্য ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হিন্দিকে রাষ্টভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে, ভারতের বিজেপি তথা মোদী সরকারের জন্য তা হিতে বিপরীত হতে পারে।
আমি ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি। হিন্দি ভাষাকে ভারতের রাষ্ট্র ভাষা বানিয়ে ঐক্যবদ্ধ করার চেয়ে। সংস্কৃত সহ ভারতবর্ষের অন্যান্য manuscripts গুলো অনুবাদের দিকে মনযোগী হলে কেবল, অমিত শাহ নয়, বিজেপি, নরেন্দ্র মোদী নয় ভারতের সকল নাগরিক, ভারতবর্ষ, এবং পুরো পৃথিবী লাভবান হবে। যা লেখার শুরুতেই ঈঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours