প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান: 

জীবন তো নদী।  অশ্রুরেখার অক্লান্ত বিরূপতা ছুঁয়েই তো দুর্দিনে বিয়োগ বেদনা৷ তোমার ব্রহ্মচর্যাশ্রম কতো দুর্দিনের ক্ষণের সঙ্গী৷ নিবেদিত প্রাণের মধ্যে ছিলেন তোমার সহধর্মিণী, এতো কম পাওয়া নয় কবি৷ অর্থ কৌলিন্য, অর্থ গৌরব তো বনেদিয়ানা। তোমার পরিবারে বউভাতের দিন বাড়ির বড়রা যৌতুক দিতেন মেয়েকে৷ বউভাতের গহনা ভরে ছিল 
জড়োয়া, সিঁথি, মুক্তোর গোছা, মল ছালনা, চুটকি..  সব বন্ধক চলে গেলো, এ কি পরম্পরা ভেদে আর্ত অভিসম্পাত নয়!!  তাও দ্বিধা করেনি তোমার ইচ্ছার কাছে  আহত সংস্কার৷ এও কি কম কবি!!  

দীর্ঘ জীবনে একে একে পতন, মৃত্যুশোক। পিতা,মেজো মেয়ে, বড়ো মেয়ে, মেজদা, দৌহিত্র, ভাইপো..  তোমার একান্ত আপন সংসার৷ রেণুকার অসুখে তুমি সময় কে সময় দাও নি, নিজেকে সমর্পণ করে সেবা করেছিলে। ভাঙনের বুকে মাথা রেখে গভীর শোক তোমাকে ক্ষণকালের জন্য স্থির করে দিয়েছিল। স্তিমিত প্রদীপে কালো ছায়া মায়ের আদর থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল শিশুপ্রাণ। বলো না গো!!  এমন করেই কি নিঃশব্দে মরণ নিয়ে যায় ,  বোধের দেশে৷ 

ভৃত্য প্রভুত্বের স্পন্দন ছাড়িয়ে নতুন স্বাদের স্নেহডোর ছুঁয়ে আছে ভালোবাসা। কিন্তু তোমার মাল্যদান নীরবে সরিয়ে দিলো তাঁকে, কান্না হাসির দোলায় নিশীথিনী বিদায়বারতা। মর্মবেদনায় ফেলে রেখে গেছে প্রতি দিবসের প্রেম। স্নেহের সঞ্চয়ে পরিপূর্ণ অজানা পথে বলে গেলে " তুমি চলে গেলে..  কিছু নাহি লয়ে "।

আড়ম্বরহীন পিতা তখন হিমালয়বাসী৷ তবু তোমার বুকে আত্মীয়তার সুখ কিন্তু সাবলীল। কবির কি শোক আছে!!  আমরা সাধারণী তাই শোক হবেই। কিন্তু তুমি সেই ভুল ভাঙিয়ে দিলে। হেমলতা ঠাকুরের কথায় তুমি অন্নজল ত্যাগ করেছিলে পত্নীবিয়োগের পর, আর!!  নিরামিষাশী কবি যেন শোধ করে গেলেন জীবনের পুঞ্জভূত বিশ্বাসের ঋণ। কাজের বোঝা তো রোজই ছিলো, কিন্তু এ কেমন অব্যক্ত রূপান্তর!!  

বিশ্বাস তো তুমিও করেছিলে। রেণুকার স্বামী যখন আর ফিরলেন না, তুমি বুঝতে পেরেছিলে এ বিশ্বাসঘাতক, তবু নীরব। বিকার যে তুমি নাও নি, সময়ের বুকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে অন্যায়ের ভ্রুকুটি।  এমন সময়ের বুকে জীবনের সজীবতাকে স্থান কয়জন দিতে পারে!!  রেণুকার বিকারেও তুমি নীরব ;সচল মহাদেবের মতো কাটিয়ে উঠেছিলে জীবনের ক্লেশ। 

মুঙ্গের বেড়াতে গিয়ে কলেরায় শেষ পিতা৷ যন্ত্রণাসিদ্ধ হৃদয়ে যাত্রা পথের অন্তিম শ্বাসটা বয়ে নিলেও, শমীর আদুরে  জীবনের সাময়িক ক্ষণ কবিকে ভেঙে দেয়৷ তুমি তো সন্তানদের  মা, তুমিই বাবা৷ সস্নেহ সজাগ টান তোমার হৃদয়ের তন্ত্রীতে পোট্রেট বলে মনে হয়৷ ছেলেবেলায় সুখস্মৃতি তো সীমাহীন আকাশের নীচে নিদারুণ করুণ বলে স্তব্ধ হলেও, বৈপরীত্য সাকার৷ তুমি বলেছিলে দুঃখ গভীর হলে ক্ষুদ্র করতে লজ্জা করে, কিন্তু শোক যে, বিপর্যয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ কষ্ট তো সকলকেই পেতে হয়, তাই একা তো তুমি প্রশ্রয় পাবে এতো বড়ো দাবি কবি!!  যা সয়, তা তো রয় কবি,  তবু সূত্র যেন ছিন্ন না হয়। 

সময়ের হাত ধরে বিষুবরেখা পার হয়েই তো চলা। রুদ্রকক্ষে সংকীর্ণশয্যায় প্রাণ বহন করেই চলা, তবু তুমি মৃত্যু বাঁধন ছিন্ন করে দেবে বলেই তো আমার বিশ্বাস৷ অখণ্ড রুগ্নতা নিয়েও তোমার ইচ্ছার বন্ধন কখনই শিথিল হয় নি৷ তুমি যে কোনোদিন দূর্বল হও নি, কারণ তুমি জানতে দূর্বলতা এক বিষম বোঝা৷  অনির্বচনীয় পীড়া তোমায় অখণ্ড রুগ্নতা দিয়েছে, তবু তুমি প্রাণ বন্ধনজালে নিবদ্ধ হয়েছ বারে বার। মৃত্যুর আহ্বান আনন্দকল্লোল তার৷ নিশীথের আশালতা সে তো পথিকের ডাক৷ বদ্ধ দুয়ারে অন্ত নেই শোক তার, তবু স্পন্দন আজ। 

প্রবৃত্তি নিয়েই সংসার আঁকড়ে থাকা৷ মৃত্যুকে নিয়ে শোক জ্বালা দুর্নিবার। মৃত্যু জীবনকে বহন করে৷ মোহ আমাদের বাঁধে, আমাদের কাঁদায়। তাই তো হাহাকার!!  নতুন বউঠান যেবার চলে যান, তোমার বেদনার জলে সুর বেজে ওঠে... 

"আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে 
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো ! 
সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে -
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত। "

বিশ্বজগতের খেলায় সত্যসাধনা হচ্ছে অমরতার সাধনা। আহত প্রাণ সবটুকু ব্যাকুলতা নিয়েই তো পথ চলে৷ অবসাদের জন্য বিমুখ মন, তবু নিষ্কর্ম্য সাধনাতেই নিযুক্তি৷ ডাঙায় তোলা জীর্ণ নৌকা ধরেই যাত্রা, অস্বচ্ছ আলোয় ঝুঁকে পড়ে মেয়াদ ভরে অভ্যর্থনা।
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours