হীরক মুখোপাধ্যায়, লেখক, হাওড়া:
শরৎ এসেছে। শরতের স্নিগ্ধ ভোরে হাওয়ায় লেগেছে হিমের পরশ। মাঠে মাঠে শ্বেত শুভ্র কাশফুল মাথা দোলাচ্ছে। বাতাসে শিউলির গন্ধ। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। সমস্ত প্রকৃতি যেন শারদ উৎসব কে স্বাগত জানানোর জন্য অপরূপা হয়ে উঠেছে। আর কয়েকদিন পরেই দেবীপক্ষের সূচনায় -" মহালয়া " । মহালয়ার ভোরে রেডিওতে প্রচারিত হবে বাণী কুমার ভট্টাচার্য্য রচিত সেই আদি অকৃত্রিম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কন্ঠে " দেবী চণ্ডীর " স্তোত্র পাঠ ।
সেই বৈদিক মন্ত্র পাঠে আকাশ বাতাস হয়ে উঠবে মুখরিত। প্রায় প্রতিটা বাড়ি থেকে ভেসে আসবে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মেঘমন্দ্র গলায় ঘোষণা " আজ দেবীপক্ষের প্রাক প্রত্যুষে জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতা মহাশক্তির শুভ আগমন বার্তা আকাশে বাতাসে বিঘোষিত। আর তারপরেই শুরু হবে স্তোত্র পাঠ।
" যা দেবী সর্বভূতেষু সংস্থিতা
নমঃ তস্মৈ নমঃ তস্মৈ নমঃ তস্মৈ নমঃ নমঃ"
সমস্ত মনটা যেন এক নির্মল আনন্দে পূর্ণ হয়ে ওঠে। মহালয়ার আগের দিন এক অসাধারণ উন্মাদনায় আমরা হিন্দোলিত হতাম। রাতে শুতে যাওয়ার আগে মাকে বলতাম , - কাল খুব ভোরে ডেকে দেবে মহালয়া শুনবো। পরেরদিন ভোরে অবশ্য ঘুম থেকে ডাকার জন্য প্রয়োজন হতো না। এমনিতেই ঘুম ভেঙে যেত। তারপর সেই প্রায়ান্ধকার ভোরে তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে বাড়িতে বাবা ,মা, ঠাকুরমা ,কাকা ,পিসি ,ভাই-বোন সকলে মিলে রেডিওর সামনে বসতাম মহালয়া শুনতে। মহালয়া শুনতে শুনতে সকলে যেন তনময় হয়ে পড়তাম। তারপর একটু সকাল হলে আমরা ছোটরা মাঠে চলে যেতাম ফুটবল খেলতে আর আমার বাবা কাছেই এক প্রতিষ্ঠা করা পুকুরে যেতেন তর্পণ করতে। একটু বেলায় টিফিন করে চলে যেতাম পাড়ার হরগৌরী বাড়িতে। আমাদের পাড়ায় তখন দুটো পুজো হত। একটা সার্বজনীন আর অন্যটা হরগৌরী বাড়ির পুজো। গতবছর 20 18 তে হরগৌরীর বাড়ির পুজো শতবর্ষ উদযাপন করেছে। সেখানে গিয়ে দেখতাম কমল পোটো
(কমল কৃষ্ণ পাল) কেমন করে খড়ের কাঠামোর ওপরে আস্তে আস্তে মাটির প্রলেপ দিয়ে মৃন্ময়ী হরগৌরী মূর্তি তৈরি করছে। অথবা চলে যেতাম আমাদের মাঠে ,।যেখানে বারোয়ারি পুজো প্যান্ডেল তৈরি হচ্ছে। সেই সময় স্কুল ছুটি থাকলে তো দেখতেই হতো না। সারাদিন ওই নির্মীয়মান প্যান্ডেলে বসে থাকতাম। কখনো কখনো মিস্ত্রিদের হাতে-হাত লাগাতাম।
আবার সময় পেলে চলে যেতাম আমার বাবা ,প্রহ্লাদ জেঠু (চ্যাটার্জী), আলো বৌদি, বেবি দিদি, অশোক মাস্টারমশাই (চ্যাটার্জী) রা যেখানে এই মহিষাসুরমর্দিনী (মহালায়া) নাট্যরূপ রিহার্সাল করছে সেইখানে। এরা নিজেরা তখন একটা শখের গ্রুপ করে সেই সময় বিভিন্ন পূজামণ্ডপে বা মন্দিরে মহালয়া পরিবেশন করতো। ওদের দলে প্রায় 20-22 জন ছিল। আমার বাবা দেবী চণ্ডীর স্তোত্র পাঠ করতেন। আমার বাবা যখন তার জলদ গম্ভীর গলায় বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে দেবী চন্ডী স্তোত্র পাঠ করতেন তখন সমস্ত শ্রোতাদের দেখতাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে থাকতে। তার সাথে প্রহ্লাদ জেঠুর দরাজ গলায় " জাগো দুর্গা জাগো দশপ্রহরণধারিণী " শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। আবার আলো বৌদি দের দরদী কন্ঠে "বাজলো তোমার আলোর বেণু " যেন মন্ডপের সমস্ত শ্রোতাদের আবেশ করে রাখত।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললে আমার এই লেখাটা শেষ করা ঠিক হবে না। ডোমজুড় "- সমাধিমন্দিরের দুর্গাপূজার উদ্বোধন হয় আমার বাবা শঙ্করলাল মুখোপাধ্যায়ের পৌরহিত্যে এবং এই পূজা প্রচলন করেন রমাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। সালটা আমার আজ আর মনে নেই তবে সম্ভবত১৯৮২- ৮৩ সাল হবে। মহা সমারোহে এই পুজো প্রচলন হয়। এই পুজোয় বহু খ্যাতিমান ব্যক্তি অতিথি হয়ে এসেছেন। সবার আগে বলতে হয় "ধন্যি মেয়ে " সিনেমার নায়ক পার্থ মুখার্জির কথা। আসতেন সুরকার অপর্ণা মুখার্জি। যিনি আবার অল ইন্ডিয়া রেডিওর ডিরেক্টর ছিলেন। আসলে ওই বাড়ির অর্থাৎ রমা কাকুর সম্পর্কে বোন হতেন অপর্ণা মুখার্জি। আর পার্থ মুখার্জী ছিলেন সম্পর্কে মুখার্জির দেওর।
আবার রমা কাকুর দাদা শ্যামাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বড় জামাই তপন বন্দ্যোপাধ্যায় সূত্রে সমাধি মন্দিরে আসতেন সুরসাগর জগন্ময় মিত্র। তপনদা ছিলেন সুরসাগর জগন্ময় মিত্রের মানসপুত্র। আর রমা কাকুদের বাড়িতে ছোট বড় সকলেই আমার বাবাকে বলতো "দাড়ি জেঠু" । সেই সূত্রে সুরসাগর জগন্ময় মিত্র আমার বাবাকে দাড়ি জেঠু বলেই ডাকতেন। এমনকি ওনার লেখা আত্মজীবনীতে তিনি আমার বাবাকে দাড়ি জেঠু বলে উল্লেখ করেছেন। যাই হোক তিনিও আমার বাবার দেবী চণ্ডীর স্তোত্র পাঠে মুগ্ধ হয়ে বহুবার তিনি আমার বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। এমনকি তিনি মাঝেমাঝেই আমার বাবাকে কিছু স্তোত্র পাঠ করতে বলতেন।
আজ ওরা অনেকেই বেঁচে নেই। অনেকেই বৃদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু আজও ওই দিনের কথা মনে পড়লে অনেকের মতো আমিও নস্টালজিক হয়ে পড়ি। আজকের স্মার্টফোনের যুগে হয়তো আমার বাবা প্রহ্লাদ জেঠু ওই গ্রুপ এর নাম সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে যেতে পারত।
এখন মহালয়ার দেবীপক্ষের ভোরে আমার স্ত্রী আমাকে ডেকে দেয়। কিন্তু আজ আর সেই আগের তাগিদ অনুভব করিনা ।কারণ টিভিতে মহালয়া দেখতে বা শুনতে কোনটাই ভালো লাগেনা। আর বর্তমান ছেলে মেয়েদের মধ্যেও মহালয়ার সেই উন্মাদনা দেখতেও পাওয়া যায় না। আগের মত সব বাড়ি থেকে সেভাবে আর ভেসে আসে না " বাজলো তোমার আলোর বেণু"।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours