fiture
মুজতবা আল মামুন,  সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
শের আলি আফ্রিদি ওরফে শের আলি খাঁন,  মাওলানা মাহমুদুল হাসান,  মাওলানা মহম্মদ আলি, মাওলানা শওকত আলি,  আসফাকুল্লাহ, বেগম হজরত মহল......  এই নামগুলো কেউ শুনেছেন ? কেউ কেউ বলতে পারেন, আজ স্বাধীনতা দিবসের দিন, গল্প ছেড়ে,  স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা বলুন...  যাঁরা জীবন দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছেন। প্রিয় পাঠকবৃন্দ, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথাই বলছি। ইতিহাসে এঁদের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এঁরা কেউ ইংরেজের নৃশংস অত্যাচার সহ্য করেছেন। কেউ জীবন পচিয়েছেন কালাপানির দেশে। কেউ আপোষ-প্রস্তাবকে লাথি মেরে, ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছেন। আমরা হতভাগ্য, ইতিহাসবেত্তারা এঁদের এড়িয়ে গেছেন ।  এই এড়িয়ে যাওয়া হয়তো কোনও অসহিষ্ণুতাবশত। হয়তো এর পিছনে ছিল কোনও অসূয়তা। ফলে আমাদের ইতিহাস পূর্ণ হয়নি। মহাফেজখানার কোনও তাকে, ধুলোর আস্তারণের নিচে, দস্তাবেজের পাতায় আজও তাঁরা তীব্র অভিমানে শয়ান। ফলে পাঠ্যেও এঁরা উপেক্ষিত রয়ে গেলেন। পড়ুয়ারা জানলো স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা দিক মাত্র। স্বাধীনতা কোনও তারিখ নয়। স্বাধীনতা কোনও পতাকাও নয়। স্বাধীনতা এক চরম পরম অনুভূতি। বুকের মধ্যে বেজে ওঠা জলতরঙ্গ। সেই লগ্নে দাঁড়িয়ে,  কেউ কেউ স্বাধীনতা আন্দোলন কুক্ষিগত করতে চান। বলেন, শুধু আমার রক্তে, আমার জীবন বলিদানে এসেছে তা। আর কারও কোনও অবদান নেই। তখন অন্ধকার গুমোট ঘরে,  নথিপত্রের পাতা থেকে হেসে ওঠেন অবহেলিতরা । সেই অনুপস্থিতি,  অনুল্লেখকে পুঁজি করে, কেউ কেউ ভিন্ন ধর্মের মানুষদের বলে বসছেন অন্য দেশে চলে যাক। কারণ, দেশ স্বাধীন করায়  তাদের কোনও ভুমিকা ছিল না।  ইংরেজদের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে যারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সব ধর্মের মানুষের স্বপ্রণোদিত উপস্থিতি ছিল বলেই ইংরেজরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল।  ইদানিং কালের গবেষণা বলছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের তাজা রক্তেই এই ভারত মুক্তি পেয়েছে। কোনও একক ধর্ম বা জাতির কারণে নয়।

ইংরেজের চরকে হত্যার দায়ে পাঠান পুরুষ শের আলি খানকে আন্দামানে নির্বাসিত করা হয়। তখন সেলুলার জেল তৈরি হচ্ছে। তা পরিদর্শনে যান বড়লাট লর্ড মেয়ো। সেখানে ছুরি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করেন শের আলি। তাতে ফাঁসি হয়। দারুল উলুম দেওবন্দ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলেও,  স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেয়। তার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে পুলিশ মাল্টায় বন্দি রাখে। লোহার রড গনগনে করে কোমরে চেপে ধরে ইংরেজ পুলিশ বলতো, তাদের পক্ষে ফতোয়া দিলে, রড তুলে নেওয়া হবে৷ মাওলানা রাজি হতেন না। তাতে তাঁর কোমরে শেষ পর্যন্ত মাংস বলে কিছু ছিল না। হাকিম আজমল খাঁ ছিলেন সর্ব ভারতের কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। সেই সময়ের বিখ্যাত চিকিৎসক। দিল্লীর বাইরে গেলে ফি নিতেন সেইসময়ে এক হাজার টাকা। গরীবদের কাছে থেকে কোন পয়সা নিতেন না। কংগ্রেস নেতা হিসেবে জেল খেটেছেন বহু বছর, নেহেরুর চাইতে তো কম না। সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি হওয়া স্বত্তেও উনার নামটাও ভারতের ইতিহাসে নেই। এমনকি মওলানা আজাদ যে জেল খেটেছিলেন সেই ইতিহাস ও নেই। খাজা আব্দুল মজিদ, ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করেন। নেহেরুর সমসাময়িক কংগ্রেস নেতা। তিনি ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই জেল খেটেছেন বহু বছর। কোথাও এটার উল্লেখ নেই। নেতাজী সুভাষ বসুর ডানহাত ও বামহাতের মতো ছিলেন, আবিদ হাসান এবং শাহেনেওয়াজ খান।  তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামে আর আজাদ হিন্দ ফৌজে ছিলেন, আজিজ আহমেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল যেড কিয়ানি, ডি এম খান, আব্দুল করিম গনি, কর্নেল জিলানী।  অমৃতসরের জালিয়ানয়ালাবাগের গণহত্যার কথা আমরা জানি, সেটা কার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে হয়েছিল সবাই জানে না।  হয়েছিল কংগ্রেস নেতা সাইফুদ্দিন কিচলুর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে। তিনি ছিলেন অতি জনপ্রিয় নেতা। জনতা তাঁর গ্রেপ্তারের সংবাদে ফুসে উঠেছিল।গোপন  দল হিসেবে অনুশীলন সমিতি, যুগান্তরের কথা জানি, যেখানে গীতা ছুঁয়ে শপথ নিতে হত।  তাই  পালোয়ান শিশু খানের উদ্যোগে গঠিত হয় ইনকিলাবি পার্টি। । পালোয়ান শিশু খান ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহিদ হন। মহম্মদ আব্দুল্লাহ কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নরম্যানকে,   যিনি অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহসনমুলক বিচারে ফাসির আদেশ দিয়েছিলেন তাঁকে একাই, কোর্টের সিড়িতে অসমসাহসে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেন, ১৭৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর।  শাহ্ ওয়লিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী। ইংরেজদের দুঃশাসন, জুলুম এবং একই সাথে ধর্মীয় কুসংস্কার ও বিদেশী অপসংস্কৃতি থেকে মুক্তি দানের লক্ষে, নিজের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে ভারতবর্ষ তথা এই বাংলার মানুষকে নবজাগরণের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বিপ্লবীদের টাকার দরকার। সরকারি টাকা লুটের ঘটনায় ছিলেন  আশফাকুল্লাহ ও তার সঙ্গিরা । কাকরি গ্রামের নিকটে এই লুটের ঘটনাটি ঘটে বলে 'কাকরি ডাকাতি' নামে এই মামলা খ্যাত হয়। প্রথমত আশফাকুল্লাহ পালাতে পারলেও পরে বিশ্বাসঘাতকতার কারনে তিনি ধরা পড়েন এবং ১৯২৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর তার ফাঁসি হয়। দুর্বল চাষীদের উপর নীলকরদের জুলুম ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ফরিদপুরের হাজি শরীয়তুল্লাহ ও তাঁর পুত্র মহসীন উদ্দীন দুদু মিয়া দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। যাকে ফারাজিয়া আন্দোলন নামে একপাশে সরিয়ে রাখা হয়।  মওলানা মোহাম্মদ আলী ও মওলানা শওকত আলী ইংরেজদের বিরুদ্ধে জনগণকে জাগিয়ে তোলেন এবং আপন আবাসভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য যে আন্দোলন গড়ে তোলেন।  এই স্বাধীনতা আন্দোলনকেও খিলাফত আন্দোলন নামে পাশ কাটানো হয়।   সুদূর উত্তর-পশ্চিমের পার্বত্য অঞ্চলে পশতুন নেতা আব্দুল গাফফার খানের নেতৃত্বে গঠিত দল 'খোদায়ি খিদমাদগার' অর্থাৎ 'আল্লাহর দাস' এর ছত্রছায়ায় এবং সমতল এলাকায় মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন, যা ইংরেজদের বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। তাঁর কথা ব্যাপক ভাবে উঠে আসে না। এই তালিকা দীর্ঘ। এই যে আজ হিন্দুত্ববাদীদের এত আস্ফালন,  বিশেষত সংখ্যালঘু নাম-গন্ধ মুছে দিতে চাইছে,  তা একদিন বা এক বছরের প্রয়াসের ফল নয়। বহু বছর ধরে এই সাম্প্রদায়িকতার চাষ চলেছে। আমরা যারা সেকুলার বলে পরিচিত,  তারা এটাকে নরম হিন্দুত্ব বলে, পাশ কাটিয়েছি। একদিন এই নরম হিন্দুত্ব যে ভয়ংকর রূপ নেবে,  তা অনুধাবন করে, নির্মূল করার চেষ্টা করিনি। ইতিহাস খুঁড়ে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করলে, এই বিষের ঝাঁঝ হয়তো এত তীব্র হতো না। এর জন্যে মুসলিম সমাজও দায়ি। আমরা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তুলে ধরিনি। বলিনি,  এই দেখ,  এরা দেশের জন্যে রক্ত দিয়েছি, প্রাণও। এ দেশ  নির্মাণে আমারও অংশগ্রহণ আছে। এ আমারও দেশ। মামুষে মানুষে আজ যে বিভেদের পাঁচিল তোলা হচ্ছে,  তাতে এই নিরপেক্ষ ইতিহাস বেশি করে সামনে আনা দরকার। গবেষণালব্ধ প্রকৃত ইতিহাস প্রকাশ্য এলে, বেশি করে আলোচিত হলে, তবেই অশুভ শক্তি সুরহীন হবে। সেই কাজটা আজ বেশি করে করা দরকার। তবেই স্বাধীনতা দিবস উদযাপন স্বার্থক হয়। না হলে,  দিনটা একটা তারিখ বা পতাকায় আটকে থাকে না।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours