বিজন কুমার সরকার, প্রবীণ সাংবাদিক, নয়াদিল্লিঃ   চিত্তরঞ্জন পার্ক। দক্ষিণ পশ্চিম দিল্লির এক বহুল পরিচিত অঞ্চল। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে সমগ্র এশিয়ার মানচিত্রে চিত্তরঞ্জন পার্ক হল বাঙালির সর্ববৃহৎ বসবাস কেন্দ্র। যা আজ এক বং ঐতিহ্যের নিরন্তন গৌরবময় অধ্যায়। অথচ এই গোরবগাথা প্রায় লুন্ঠিত হতে বসেছিল এক সংখ্যালঘু সংস্থার স্বেচ্ছাচারিতায়। সাধারণত ১৭০০ থেকে ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়কাল থেকে বাঙ্গালিরা ধীরে ধীরে খুব অল্প সংখ্যায় হলেও দিল্লির অভিমুখে যেতে শুরু করে। ব্রিটিশ রাজের যুগে ভারতের রাজধানী কলকাতার পরিবর্তে দিল্লি হলে নানান চাকরির সুবাদেও বাঙালিরা কিন্তু দিল্লিকে পছন্দের শহর হিসেবে বেছে নেন। আর ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের মূহুর্তেও প্রচুর সংখ্যায় বাঙালিরা ভিড় জমান এই দেশের রাজধানীকে কেন্দ্র করে। সেই সময় যাঁরা দিল্লিতে এসেছিলেন দেশ ভাগের যন্ত্রণাকে বুকে রেখে তাঁরা অধিকাংশই কিন্তু নিজস্ব মাতৃভূমিকে পরিত্যাগ করে আসতে বাধ্য হন বাঁচার তাগিদে। স্বদেশ ভূমি ছেড়ে আসা অসহায় বাঙালিরা তখন দিশেহারা এক নতুন ভুখন্ডে। ঠিক সেই সময়ে ত্রাতার ভুমিকায় এগিয়ে এলেন তদানীন্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার শ্যামাপ্রসন্ন সেনভার্মা, এস জি বসুমল্লিক, সি কে মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ দত্ত প্রমুখ বাঙালি ব্যক্তিত্ব। মূলত তাঁদের উদ্যোগেই গঠিত হল ইষ্ট পাকিস্তান ডিসপ্লেসড পার্সনস অ্যাসোসিয়েশন (ইপিডিপি)। বাঙালিদের বসবাসের প্রাপ্যস্থল নিয়ে শুরু হয় আন্দোলন। নড়েচড়ে বসে দিল্লির সরকার। অবশেষে ১৯৭০ সালের মধ্যবর্তী সময় থেকে উদ্বাস্তু বাঙালিদের বসবাসের জন্য জমি প্রদান করা শুরু হয় সরকারি বদান্যতায়। দক্ষিণ দিল্লির এই রুক্ষ জমিতেও ভূমি প্রাপকদের বিনিময়ে দিতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রামাণ্য নথি। দেশের রাজধানীতে বাঙালিরা যেখানে নিজের বাসস্থানের ভূমির জন্য উৎকন্ঠায় অস্থির তারই মধ্যে মাথা চাড়া দেয় অনিয়মের আবর্ত। সে জমি বন্টন শুরু হয় ঠিকই, তা কিন্তু তিনটে পৃথক লটারীর মাধ্যমে সংগঠিত হয়েছিল। এরই মধ্যে দেখা দিল বেনিয়মের সূর্যোদয়। দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির সঙ্গে জমি বন্টন প্রসঙ্গে মিনিস্ট্রি অব হাউসিং এন্ড আরবান ডেভেলপমেন্ট মন্ত্রক যোগাযোগ রেখে চলছিল। তারা যৌথভাবে ২৮৬১ টি প্লট বিলির মনস্থ করলেই এক শ্রেণির প্রভাবশালী ও বিত্তশালীরা সিংহভাগ জমি করায়ত্ব করে নেন। সেই করায়ত্বের বজ্রমুষ্ঠি এতই বেনিয়মে ভরপুর ছিল যা কালের নিয়মে গ্রাহ্যের মান্যতাই পেয়ে যায়। ক্রমেই সেই স্থান গোবিন্দপুরী এক্সটেনশন নামে খ্যাত হয়। এদিকে জমি বিলি বন্টনে কিছু অসঙ্গতি দেখা দিলেও প্রায় সমস্ত জমি আবেদনকারীর আর্জি মঞ্জুর করে সবাইকে জমি দেওয়ার পক্ষেই নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় তদানীন্তন সরকার। এরপর বাকি সবাইকে দিল্লির বিভিন্ন স্থানে জমি দিতে গেলে সরকারের বিরুদ্ধেও অনেকে সোচ্চার হন। তাঁদের দাবি ছিল, বসবাসের জন্য আবেদনকারীদের জমি দিতে হবে বাঙালি অধ্যুষিত ইপিডিপি কলোনিতে বা তার সংলগ্ন এলাকার মধ্যে। পরবর্তী পর্যায়ে আবেদনকারীদের দাবিতে সবুজ সংকেত দেখিয়েই প্রস্তাবিত এলাকায় এম, এ্‌ ও, পি, কে-১, কে-২, ৪০ এবং ৫২ নামে পকেট তৈরি করা হয়। ওই সমস্ত পকেটকে কেন্দ্র করে মোট ৭১৪ টি প্লট বিলির মঞ্জুরি দেওয়া হয়েছিল। যদিও সেই প্লটগুলি ঘিরেও খানিকটা অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ বসবাস যোগ্য ওই প্লটগুলির আয়তন হবার কথা ছিল ১৬০ বর্গ গজ। কিন্তু বিলির সময় সেই আয়তন কমিয়ে দেওয়া হয় ১২৫ বর্গ গজে। অন্যদিকে, এই ইপিডিপি কলোনির আরও এক মাইলস্টোন হল কে ডি গুহ রায় ঠাকুরতার বাড়ি। এই কলোনিতে তাঁর বাড়িই যে প্রথম নির্মিত হয় জি ব্লকে। কে ডি গুহ রায় ঠাকুরতার বাড়ি নির্মাণ নিয়েও কিন্তু কম নাটকীয়তা হয়নি। ইপিডিপি কলোনিতে এই বাড়ি করতে গিয়ে তিনিও চরম নৈরাজ্যের শিকার হন। ১৯৭০ সালে তিনি তাঁর স্বপ্নের বাড়ি নির্মাণ করতে গেলে নিয়ম মেনেই প্ল্যান প্রস্তুত করে নেন। এমনকি নির্মাণকর্মীও চুক্তির ভিত্তিতে ভাড়া করে ফেলেন। যে দিন বাড়ি তৈরির প্রথম কাজ শুরু হবে ঠিক তার আগের দিন নিজের জমি পরিদর্শণ করতে গিয়েই তিনি চরম সংকটে পড়েছিলেন। নিজের জমি দেখতে গিয়ে দেখেন কোথায় সেই জমি? গোটা ইপিডিপি কলোনিকে কাঁটা তার দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। এমনকি জমির মানচিত্র পালটে ফেলা হয়েছে। পরিবর্তিত মানচিত্রে বরং উল্লেখ করা হয়েছিল সংখ্যালঘু একটি গোষ্ঠীর অধীনে চলা বেসরকারি সংস্থার মালিকানায় রয়েছে পুরো জমিটি। কিন্তু সেদিন কে ডি গুহ রায় ঠাকুরতা অন্যায়ের সামনে বশ্যতা মেনে নেননি। বরং দিল্লির দরবারে সেদিন তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ধমনীতে বইছে বাঙালির রক্ত। আর মনে অদম্য জেদ। তিনিও ছুটে যান দিল্লিতে কর্মরত এক পদস্থ পুলিশ আধিকারিকের কাছে। এমনিতে সেই পুলিশ আধিকারিক ছিলেন তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু। মূলত সেই পুলিশ বন্ধুর পরামর্শে ও সংশ্লিষ্ট থানার সহযোগিতায় ওই রাতেই আচমকা শুরু করে দেন বাড়ির নির্মাণ কাজ। তারজন্য প্রচুর সংখ্যক ভাড়াটে নির্মাণকর্মীকে সংগঠিত করতে হয়েছিল তাঁকে। পাশাপাশি পরের দিন সকালে তিনি জমি দখলদারদের বিরুদ্ধে থানায় আইন মোতাবেক নালিশ দায়ের করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় নথি পেশ না করতে পারলে দখলদারেরা সেখান থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়। সেদিন দিল্লির ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে যায় কে ডি গুহ রায় ঠাকুরতার নাম। কারণ সেদিন তিনি রুখে না দাঁড়ালে দখলদারদের কড়াল থাবা থেকে ইপিডিপি কলোনিকে বাঁচানো যেত না। পালটে যেত ইপিডিপি কলোনির ইতিবৃত্ত। পরবর্তী পর্যায়ে এই ইপিডিপি কলোনি পরিচিত হয় পুর্বাঞ্চল নামে। যা আজকে বাঙালি সমাজের কাছে সবার মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় আরও এক বহুল প্রিয় নামে...”চিত্তরঞ্জন পার্ক।”


 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours